সবরের বর্ণনা

মহান আল্লাহ বলেনঃ

‘হে ঈমানদারগন! তোমরা ধৈর্য ধারণ কর এবং ধৈর্যের প্রতিযোগিতা কর।’ (আলে-ইমরানঃ ২০০)

তিনি আরো বলেনঃ

‘আমি তোমাদেরকে ভয় ও ক্ষুধা দিয়ে অবশ্যই পরীক্ষা করব। এছাড়া তোমাদের জান, মাল ও শস্যের ক্ষতিসাধন করব। (এ ব্যাপারে) ধৈর্যশীলগণকে সুসংবাদ দাও।’ (বাকারাঃ ১৫৫)

তিনি আরো বলেনঃ

ধৈর্যশীলগণকে অগণিত পুরস্কারে ভূষিত করা হবে। (জুমারঃ ১০)

তিনি আরো বলেনঃ

যে ব্যক্তিই ধৈর্য অবলম্বন করে এবং ক্ষমা করে দেয়, নিঃসন্দেহে সেটা (তার) দৃঢ় মনোবলেরই অন্তর্ভুক্ত। (সূরা শূরাঃ ৪৩)

তিনি আরো বলেনঃ

ধৈর্য (সবর) ও নামাযের মাধ্যমে তোমরা (আল্লাহর) সাহায্য কামনা করো। আল্লাহ নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের সঙ্গে রয়েছেন। (বাকারাহঃ ১৫৩ আয়াত)

তিনি আরো বলেনঃ

আমি তোমাদেরকে অবশ্যই পরীক্ষা করব, যাতে করে তোমাদের মধ্যকার মুজাহিদ ও ধৈর্যশীলগণকে চিনে (যাচাই করে) নিতে পারি (মুহাম্মাদঃ ৩১)

ধৈর্য (সবর) ও তার ফযীলত সংক্রান্ত এ ধরনের আরো বহু আয়াত পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে।

 

২৫. হযরত আবু মালিক আশ্আরী (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ পবিত্রতা ঈমানের অর্ধাংশ। আর আল-হামদুলিল্লাহ জমিনকে পূর্ণতা দান করে। আর সুবহানাল্লাহু ও আল-হামদুলিল্লাহ একত্রে বা একাকী আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী সবকিছুকে পূরণ করে দেয়। নামায হচ্ছে আলোক এবং সাদকা (ঈমানের) প্রমাণ স্বরূপ। অন্যদিকে ধৈর্য (সবর) হচ্ছে জ্যোতি তুল্য এবং কুরআন তোমার পক্ষের কিংবা বিপক্ষের একটি দলিল। আর প্রত্যেক ব্যক্তিই সকালে উঠে নিজেকে বিক্রি১* করে দেয়; অতপর সে নিজেকে মুক্ত করে কিংবা ধ্বংস করে। (মুসলিম)

১* অর্থ্যাৎ কেউ নিরপেক্ষ থাকে না বা থাকতে পারে না। তাকে অবশ্যই কোন কিছুর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে জীবন কাটাতে হয় সেটা ভালো হোক কি মন্দ।


২৬. হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) বর্ণনা করেন, আনসারদের কতিপয় ব্যক্তি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সাহায্য চাইল। তিনি তাদেরকে সাহায্য দিলেন। তারা আবার চাইল। তিনি আবারও দান করলেন। এমনকি, তাঁর নিকট যা কিছু ছিল, তা সবই নিঃশ্বেষ হয়ে গেল। এভাবে হাতের সবকিছু দান করার পর তিনি লোকদের বললেনঃ আমার হাতে যে ধন-মাল আসে তা আমি তোমাদেরকে না দিয়ে সঞ্চয় করে রাখি না। (জেনে রেখো) যে ব্যক্তি পবিত্র থাকতে চায়, আল্লাহ তাকে পবিত্রই রাখেন। যে ব্যক্তি কারো মুখাপেক্ষী হতে চায় না, আল্লাহ তাকে স্বাবলম্বী করে তোলেন। যে ব্যক্তি ধৈর্য অবলম্বন করতে চায় আল্লাহ তাকে ধৈর্যশীলতা দান করেন। ধৈর্যের চাইতে উত্তম ও প্রশস্ত আর কোন জিনিস কাউকে দেয়া হয়নি। (বুখারী ও মুসলিম)


২৭. হযরত আবু ইয়াহ্‌ইয়া সুহাইব ইবনে সিনান (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘মুমিনের ব্যাপারটা খুবই বিস্ময়কর। (কেননা) তার সকল কাজই কল্যাণপ্রদ। মুমিন ছাড়া অন্যের ব্যপারগুলো এ রকম নয়। তার জন্য আনন্দের কিছু ঘটলে সে আল্লাহর শোকর গুযারী করে; তাতে তার মঙ্গল সাধিত হয়। পক্ষান্তরে ক্ষতিকর কিছু ঘটলে সে ধৈর্য অবলম্বন করে। এটাও তার জন্য কল্যাণকরই প্রমাণিত হয়।’ (মুসলিম)


২৮. হযরত আনাস (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব বেশি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লে রোগ যন্ত্রণায় তিনি অজ্ঞান হতে লাগলেন। এতে হযরত ফাতেমা (রা) বললেনঃ আহ্, আমার বাবার কি কষ্ট হচ্ছে! রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেনঃ ‘আজকের দিনের পর তোমার বাবার আর কষ্ট হবে না।’ তিনি (নবী করীম) যখন ইন্তেকাল করলেন, তখন ফাতেমা (রা) বললেনঃ ‘হায়! বাবা আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন। হে বাবা! জান্নাতুল ফিরদৌস আপনার বাসস্থান! হায়! হযরত জিব্রীলকে আপনার ইন্তেকালের সংবাদ দিচ্ছি।’ তাঁর দাফনের কাজ শেষ হলে তিনি বললেনঃ “রাসূলে আকরাম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর মাটি নিক্ষেপ করতে কি তোমাদের ইচ্ছা হলো?” (বুখারী)


২৯. রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আযাদকৃত গোলাম যায়েদ ইবনে হারেসার পুত্র উসামা (রা) বলেনঃ একদা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক কন্যা তাঁর পুত্রের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে বলে সংবাদ দিয়ে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সেখানে আসতে অনুরোধ জানালেন। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংবাদ বাহকের মাধ্যমে তাকে সালাম জানিয়ে বললেনঃ ‘আল্লাহ যা নিয়ে গেছেন তা তাঁরই। আল্লাহর কাছে প্রতিটি বস্তুর একটি নির্দিষ্ট সময়-কাল রয়েছে। সুতরাং তোমার ধৈর্য অবলম্বন করে আল্লাহর কাছ থেকে সওয়াবের পুরস্কারে আকাংখা পোষণ করা উচিত।’ কন্যা দ্বিতীয়বার তাঁকে কসম দিয়ে তাঁর কাছে আসতে বললেন। এ সময় রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা’দ ইবনে উবাদা, মু’আয ইবনে জাবাল, উবাই ইবনে কা’ব, যায়েদ ইবনে সাবিত এবং আরো কতিপয় সাহাবীসহ উঠে গেলেন। এরপর শিশুটিকে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ন্যস্ত করা হলো। তিনি তাকে নিজের কোলের ওপর বসালেন। এ সময় শিশুটির প্রাণ অস্থির  হয়ে যেন বেরিয়ে আসছিল। তখন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুচোখ দিয়ে অশ্রু গড়াতে লাগল। এতে উৎসুক হয়ে সা’দ জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘একি হে আল্লাহর রাসূল’! তিনি বললেন, এটা আল্লাহর রহমত, যা তিনি স্বীয় বান্দাদের হৃদয়ে সঞ্চারিত করেছেন।’ অপর এক বর্ণনায় আছে; আল্লাহ তাঁর ইচ্ছামত বান্দাদের হৃদয়ে রহমত দান করেন। (বুখারী  ও মুসলিম)


৩০. হযরত সুহায়েব (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের পূর্বেকার লোকদের মধ্যে একজন বাদশাহ ছিল। তার দরবারে ছিল একজন জাদুকর। সে যখন বার্ধক্যে উপনীত হলো, তখন বাদশাহকে বললঃ  ‘আমি একদম বুড়ো হয়ে গেছি। সুতরাং একটি বালককে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। আমি তাকে জাদু শিখিয়ে দেব।’ সে মতে বাদশাহ একটি কিশোরকে জাদু শেখানোর জন্যে তার কাছে পাঠালেন। তার চলাচলের পথে ছিল এক খৃস্টান দরবেশ। বালকটি দরবেশের কাছে বসে তার কথাবার্তা শুনে চমৎকৃত হলো। এভাবে জাদুকরের কাছে যাতায়াতের পথে দরবেশের কাছে বসতে লাগল। একদিন জাদুকরের কাছে গেলে সে তাকে খুব মারধর করল। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে সে দরবেশের কাছে এ ব্যাপারে নালিশ করল। দরবেশ তাকে উপদেশ দিল, তোমার মনে যখন জাদুকরের জিজ্ঞাসাবাদের ভয় জাগবে তখন তাকে বলবেঃ আমার পরিবার আমাকে আটকে রেখেছিল। আর যখন তোমার মাঝে স্বীয় পরিবারবর্গের ভয় জাগবে, তখন তাদেরকে বলবে, জাদুকর আমায় আটকে রেখেছিল।

এই পরিস্থিতিতে একদিন এক বিরাট জন্তু এসে লোকদের চলাচলের পথ বন্ধ করে দিল। বালকটি তখন মনে মনে ভাবলঃ আজ আমার জানতে হবে যে, দরবেশ শ্রেষ্ঠ, না জাদুকর শ্রেষ্ঠ? অতপরঃ সে একটি পাথর খণ্ড হাতে নিয়ে প্রার্থনা করলঃ হে আল্লাহ! তোমার কাছে যদি জাদুকরের চেয়ে দরবেশের কাজ বেশি পছন্দনীয় হয়, তাহলে লোকদের পথ চলাচলের সুবিধার্থে এই জন্তুটাকে মেরে ফেল। এরপর সে উক্ত পাথর খণ্ডটি ছুড়ে মারল এবং তাতে জন্তুটি মারা গেল। এতে চলাচলের পথটি উন্মুক্ত হয়ে গেল এবং লোকেরাও নিজ নিজ লক্ষ্যপানে চলে গেল। এরপর সে দরবেশের কাছে এসে এ খবরটি তাকে জানাল। দরবেশ তাকে বললঃ ‘হে প্রিয় বৎস! আজ তুমি আমার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছ। আমার মতে, আজ তুমি একটি বিশেষ পর্যায়ে উপনীত হয়েছ; তুমি খুব শিগগিরই একটি কঠিন পরীক্ষায় নিপতিত হবে। কাজেই তুমি যখন কোন বিপদে ফেঁসে যাবে, তখন আমার সম্পর্কে কাউকে কোন সন্ধান দেবে না।’

বালকটি মানুষের সব জটিল রোগের চিকিৎসা করত; বিশেষত অন্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে সে সুস্থ করে তুলত। তৎকালীন বাদশাহ্‌র দরবারে এক লোক অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে এ খবর শুনে অনেক উপঢৌকন নিয়ে এসে বালকটিকে বললঃ  ‘তুমি আমায় সুস্থ করে তুলবে, এ প্রত্যাশায়ই আমি তোমার জন্য এত উপঢৌকন নিয়ে এসেছি।’ জবাবে বালকটি বললোঃ  আমি তো কাউকে সুস্থতা দান করি না, আল্লাহই প্রকৃতপক্ষে সুস্থতা দান করেন। তুমি যদি আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখো, তাহলে তোমার সুস্থতার জন্য আমি আল্লাহর কাছে দো’আ করব।’ লোকটি তখন আল্লাহর প্রতি ঈমান আনল। আল্লাহও তাকে সুস্থতা দান করলেন। তারপর সে বাদশাহর দরবারে যথারীতি আসন গ্রহণ করল। বাদশাহ তাকে প্রশ্ন করলঃ কে তোমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিল? সে জবাব দিল আমার প্রভু (রব্ব)।   বাদশাহ আবার তাকে প্রশ্ন করলঃ কে তোমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিল? সে জবাব দিল আমার প্রভু। এবার বাদশাহ প্রশ্ন করলঃ আমি ছাড়াও কি তোমার কোনো প্রভু আছে? সে বলল, ‘আল্লাহই আমার ও তোমার প্রভু।’ এতে ক্রুদ্ধ হয়ে বাদশাহ তাকে শাস্তি দিতে লাগল। শাস্তি সহ্য করতে না পেরে সে বালকটির নাম বলে দিল। সে মতে বালকটিকে ডেকে আনা হলো। বাদশাহ তাকে স্নেহের সুরে বললেন হে প্রিয় বালক! তোমার সম্পর্কে আমার কাছে খবর পৌঁছেছে যে, তুমি নাকি জাদুবিদ্যার সাহায্যে অন্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে নিরাময় দান করো এবং আরও নানা রকমের রোগীকে সুস্থ করে তোল। জবাবে বালকটি বললঃ  মহামান্য বাদশাহ্‌! আমি কাউকে সুস্থতা দান করি না। সুস্থতা তো আল্লাহই দান করেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে বাদশাহ তাকে শাস্তি দিতে লাগল। শেষ পর্যন্ত সে খৃস্টান দরবেশের নাম বলে দিল। সে মতে দরবেশকে ডেকে আনা হলো এবং তাকে তার ধর্ম (দ্বীন) থেকে ফিরে আসতে বলা হলো। কিন্তু সে তাতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করল। তখন বাদশাহ জনৈক কর্মচারীকে একটি করাত আনতে বলল। করাত নিয়ে এলে সেটিকে দরবেশের মাথার ঠিক মাঝ বরাবর স্থাপন করে তাকে চিরে ফেলা হলো। এরপর বালকটিকেও নিয়ে আসা হলো এবং তাকেও তার ধর্ম দ্বীন থেকে ফিরে আসতে বলা হলো। কিন্তু সে দৃঢ়ভাবে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করল। তখন বাদশাহ তাকে কতিপয় সঙ্গীর হাতে তুলে দিয়ে বললঃ  তোমরা তাকে অমুক পাহাড়ের ওপর নিয়ে যাও। যখন তোমরা পাহাড়ের উঁচু শিখরে গিয়ে উঠবে, তখন সে যদি তার ধর্ম ত্যাগ করে, তবে তো ঠিক। নচেৎ সেখান থেকে তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেবে।

সে মতে লোকেরা ছেলেটিকে নিয়ে পাহাড়ে উঠল। ছেলেটি বললঃ ‘হে আল্লাহ! তুমি যেভাবে পছন্দ করো এদের কবল থেকে আমায় মুক্তি দান করো।’ এ সময় পাহাড়টি হঠাৎ কেঁপে উঠল এবং তারা সবাই নিচে পড়ে গেল। আর ছেলেটি বাদশাহর কাছে ফিরে এল। বাদশাহ্‌ তাকে জিজ্ঞেস করলঃ ‘তোমার সঙ্গীদের কী হয়েছে?’ ছেলেটি বললঃ ‘আল্লাহ তাদের কবল থেকে আমায় রক্ষা করেছেন।’ বাদশাহ তখন তাকে অন্য কতিপয় সঙ্গীর হাতে ন্যস্ত করে বললঃ একে তোমরা একটি ছোট্ট নৌকায় তুলে গভীর সমুদ্রে নিয়ে যাও। অতঃপর সে যদি তার ধর্ম (দ্বীন) ত্যাগ না করে, তবে তাকে তোমরা সেখানে (সমুদ্রে) ফেলে দাও। এই নির্দেশ মোতাবেক লোকেরা তাকে নিয়ে সমুদ্রপথে চললো। ছেলেটি প্রার্থনা করলঃ হে আল্লাহ! তুমি যেভাবে পছন্দ করো, এদের কবল থেকে আমায় মুক্তি দাও। এরপর নৌকাটি তাদের নিয়ে ডুবে গেল এবং তারা সবাই মৃত্যুবরণ করল। ছেলেটি বাদশার কাছে ফিরে এলো। বাদশাহ তাকে জিজ্ঞেস করলঃ তোমার সঙ্গীদের ভাগ্যে কি ঘটেছে? সে জবাব দিলঃ আল্লাহই আমাকে তাদের কবল থেকে রক্ষা করেছেন। অতঃপর সে বাদশাহকে লক্ষ্য করে বললঃ তুমি আমার নির্দেশ মোতাবেক কাজ করো তবেই আমাকে হত্যা করতে পারবে। বাদশাহ জিজ্ঞেস করলঃ সেটা কি ধরনের কাজ? সে বললঃ একটি মাঠে লোকদের জড়ো কর। তারপর আমায় শুলের ওপর বসাও এবং আমার তীরদানি থেকে একটি তীর নিয়ে ধনুকের মাঝ বরাবর রেখে বলোঃ ‘বিসমিল্লাহি রাব্বিল গোলাম’ (অর্থ্যাৎ বালকটির প্রভু আল্লাহর নামে তীর ছুঁড়ছি) –এই বলে তীর ছুঁড়ো। এভাবে তীর ছুঁড়লেই তুমি আমায় হত্যা করতে পারবে।

বাদশাহ তখন একটি মাঠে লোকদের জড়ো করে ছেলেটিকে শুলের ওপর বসিয়ে তার তীরদানি থেকে একটি তীর ধনুকের মাঝখানে স্থাপন করে ‘বিসমিল্লাহি রাব্বিল গোলাম’ বলে তার প্রতি ছুঁড়ে মারল। তীরটি বালকটির কানের পাশ দিয়ে মাথা ভেদ করল এবং তাৎক্ষণাৎ তার মৃত্যু ঘটল। এতে লোকেরা বলতে লাগলঃ ‘আমরা বালকটির প্রভু আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলাম।’ এ সংবাদ বাদশাহর নিকট পৌঁছালে তাকে বলা হলো, ‘যে আশংকা তুমি পোষণ করেছিলে, তা-ই তো হয়ে গেল; অর্থ্যাৎ সব লোকেরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে।’ বাদশাহ তখন রাস্তার পাশে বিরাট আকারের গর্ত করার নির্দেশ দিল। অতঃপর গর্ত খনন করে তাতে আগুন জ্বালানো হলো। বাদশাহ ঘোষণা করলো, কোন ব্যক্তি তার ধর্ম (দ্বীন) থেকে ফিরে আসতে না চাইলে তাকে তোমরা গর্তে নিক্ষেপ করো। এ ঘোষণা অনুসারে যারা স্বীয় দ্বীন থেকে ফিরে আসতে অস্বীকৃতি জানাল, তাদেরকে আগুনে ছুঁড়ে মারা হলো। শেষ পর্যন্ত একজন মহিলা তার সন্তানসহ এলো। সে আগুনে ঝাঁপ দিতে ইতঃস্তত করলে তার সন্তান বললঃ ‘আম্মা! আপনি ধৈর্য ধারণ করুন। (অর্থ্যাৎ আগুনে ঝাঁপ দিতে ইতঃস্তত করবেন না); কারণ আপনি তো সত্যের ওপর রয়েছেন।’ (মুসলিম)


৩১. হযরত আনাস (রা) বর্ণনা করেন, একদা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। মহিলাটি একটি কবরের পাশে বসে কাঁদছিল। তিনি (মহিলাটিকে) বললেনঃ ‘(ওহে! তুমি) আল্লাহকে ভয় এবং ধৈর্য অবলম্বন (সবর) করো।’ মহিলাটি বললঃ আপনি আমাকে কিছু না বলে নিজের কাজ করুন। কারণ আপনি তো আমার মতো কোনো মুসিবতে পড়েননি। আসলে মহিলাটি তাঁকে চিনতে পারেনি। তখন তাকে বলা হলো, ইনি হচ্ছেন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মহিলাটি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাড়ির দরজায় এলো এবং সেখানে কোনো দারোয়ান দেখতে পেল না। এরপর মহিলাটি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বললোঃ ‘আমি আপনাকে চিনতে পারিনি।’ রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ধৈর্যশীলতা (সবর) তো প্রথম আঘাতের সময়ই প্রকাশ পেয়ে থাকে। (বুখারী ও মুসলিম)

মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ মহিলাটি তার এক শিশুপুত্রের জন্য কাঁদছিল।


৩২. হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘মহান আল্লাহ ইরশাদ করেনঃ আমার মুমিন বান্দার জন্যে আমার কাছে জান্নাত ছাড়া আর কোনো পুরস্কার নেই, যখন আমি দুনিয়া থেকে তার (কোনো) প্রিয়জনকে কেড়ে নিয়ে যাই আর সে তখন সওয়াবের আশায় ধৈর্য (সবর) অবলম্বন করে।’  (বুখারী)


৩৩. হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করেন, একদা তিনি প্লেগ রোগ সম্পর্কে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেনঃ এটা হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা আযাব বিশেষ। আল্লাহ যাকে চান, তার জন্যই একে পাঠান। কিন্তু তিনি মুমিনের জন্য একে রহমতে পরিণত করেছেন। কোনো মুমিন বান্দা এ রোগে আক্রান্ত হলে সে যদি নিজ এলাকায় ধৈর্যের সাথে সওয়াবের নিয়্যতে এ কথা মনে রেখে অবস্থান করে যে, আল্লাহ তার জন্য যা নির্ধারণ করে রেখেছেন, তাতেই সে ভুগবে (এবং সে মৃত্যুবরণ করবে) তবে সে শহীদের মতোই সওয়াব পাবে। (বুখারী)


৩৪. হযরত আনাস (রা) বর্ণনা করেন, আমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, মহান আল্লাহ বলেছেনঃ আমি যখন আমার বান্দাকে তার দু’টি প্রিয় জিনিসের (চোখের) ব্যাপারে পরীক্ষায় ফেলি (অর্থ্যাৎ তার দুই চোখের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করে দেই) এবং তাতে সে ধৈর্য অবলম্বন করে, তখন এর বিনিময়ে আমি তাকে বেহেশ্‌ত দান করি। (বুখারী)


৩৫. হযরত ‘আতা ইবনে আবু রিবাহর বর্ণনা, আমাকে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেনঃ আমি কি তোমায় একজন বেহেশ্‌তী মহিলা দেখাব না? আমি বললামঃ হ্যাঁ, অবশ্যই। তিনি (ইশারা করে) বললেনঃ এই কাল মহিলাটি। সে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলছেঃ ‘আমি মৃগী রোগে আক্রান্ত হয়েছি এবং এর ফলে আমার শরীর আবৃত রাখা যাচ্ছে না। অনুগ্রহ পূর্বক আপনি আমার জন্য একটু দোয়া করুন।’ তিনি বললেনঃ তুমি চাইলে ধৈর্য ধারণ করতে পারো; তার ফলে তুমি বেহেশত লাভ করবে। আর যদি চাও তো তোমার নিরাময়ের জন্য আমি দো’আ করতে পারি।’ সে বললঃ  আমি ধৈর্য ধারণ করব। তবে আমার দেহ যাতে অনাবৃত হয়ে না যায়, সেজন্যে আল্লাহর নিকট দো’আ করুন। অতঃপর তিনি তার জন্য দো’আ করলেন। (বুখারী ও মুসলিম)


৩৬. হযরত আবদুল্লাহ বিন্ মাসউদ বর্ণনা করেন, আমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম। তিনি নবীগনের ভেতর থেকে জনৈক নবীর অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলছিলেন যে, তাঁর জাতির লোকেরা তাঁকে মেরে রক্তাক্ত করে ফেলেছিল আর তিনি স্বীয় মুখমণ্ডল থেকে রক্ত মুছে ফেলতে ফেলতে বলছিলেন, ‘হে আল্লাহ! আমার জাতিকে মাফ করে দাও; কারণ এরা (কি করছে) জানে না।’ (বুখারী ও মুসলিম)


৩৭. হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) ও হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ মুসলিম বান্দার যে কোন রোগ-ব্যাধি, দৈহিক শ্রান্তি, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ ও অস্থিরতা হোক না কেন, এমনকি দেহে কাঁটা বিঁধলেও সে কারণে আল্লাহ তার গুনাহ ক্ষমা করে দেন। (বুখারী ও মুসলিম)


৩৮. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণনা করেন, একদা আমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গেলাম। তখন তিনি প্রচণ্ড জ্বরে কাঁপছিলেন। আমি তাঁকে বললামঃ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি তো প্রচণ্ড জ্বরে কাঁপছেন।’ তিনি বললেন হ্যাঁ, তোমাদের মত দু’জনের সমান জ্বরে কাঁপছি।’ আমি বললাম এটা কি এজন্যে যে, এতে আপনার জন্য দ্বিগুণ সওয়াব রয়েছে? তিনি বললেন হ্যাঁ, ঠিক তাই। মুসলিম বান্দাহ্‌ কাঁটা কিংবা অন্য কোনো বস্তু দ্বারা কষ্ট পেলে আল্লাহ অবশ্যই সে কারণে তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন। আর তার ছোট ছোট গুনাহগুলো গাছের শুকনো পাতার মতো ঝরে পড়ে যায়। (বুখারী ও মুসলিম)


৩৯. হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ  আল্লাহ যে ব্যক্তির কল্যাণ চান তাকে বিপদে (পরীক্ষায়) ফেলেন।


৪০. হযরত আনাস (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ  তোমাদের কেউ কোনো বিপদে বা কষ্টে নিপতিত হলে সে যেন মৃত্যুর আকাংখা ব্যক্ত না করে। কেউ যদি কিছু ব্যক্ত করতেই চায়, তবে যেন বলে, হে আল্লাহ! তুমি আমায় যতক্ষণ জীবিত রাখো, যতক্ষণ জীবিত থাকা আমার জন্য কল্যাণকর। আর যখন মৃত্যুবরণ করা আমার জন্য কল্যাণকর, তখন আমায় মৃত্যু দান করো। (বুখারী ও মুসলিম)


৪১. হযরত আবু আবদুল্লাহ খাব্বাব ইবনে ইআরাতি (রা) বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, একদা আমরা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে মক্কার কাফেরদের শত্রুতার ব্যাপারে অভিযোগ করলাম। সে সময় তিনি মাথার নীচে চাদর রেখে কা’বার ছায়ায় শুয়ে আরাম করছিলেন। আমরা নিবেদন করলামঃ ‘আপনি কি আমদের জন্য আল্লাহর নিকট সাহায্য চাইবেন না এবং আমাদের জন্যে তাঁর নিকট দো’আও করবেন না।’ তিনি বললেনঃ ‘তোমাদের পূর্বেকার জামানায় মানুষকে ধরে নিয়ে মাটির গর্তে দাঁড় করানো হতো। তারপর করাত দ্বারা কারো মাথা থেকে লম্বালম্বি গোটা দেহকে চিরে ফেলা হতো। কারো শরীরের গোশত ও হাড় লহার চিরুনী দ্বারা আচঁড়িয়ে ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়া হতো। তবুও কাউকে তার দীন থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। আল্লাহর কসম! এ দ্বীনকে তিনি পূর্ণভাবে কায়েম করে দেবেনই। এমনকি, তখন একজন পথিক (বা যাত্রী) সান্‌আ থেকে হাযরা মাউত অবধি সফর করবে; কিন্তু আল্লাহ স্বীয় মেষপালের জন্যে নেকড়ে ছাড়া সে আর কিছুর ভয় করবে না; কিন্তু তোমরা খুবই তাড়াহুড়ো করছো।’ (বুখারী)

অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ তিনি অর্থ্যাৎ রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চাদর রেখেছিলেন মাথার নীচে আর মুশরিকরা আমাদের অনেক কষ্ট দিচ্ছিল।


৪২. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বর্ণনা করেনঃ হুনাইনের যুদ্ধে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু লোককে গনীমতের মালের অংশ বেশি দিয়েছিলেন। (নও-মুসলিমদের মন আকুষ্ট করার জন্যই এটা করা হয়েছিল।) তিনি আকরা ইবনে হাবেস এবং ‘উয়ায়না ইবনে হিসনকে এক শত করে উট দান করেছিলেন। এ ছাড়া আরবের উচ্চ বংশীয় লোকদেরকে মর্যাদা অনুসারে বেশি বেশি করে দিয়েছিলেন। এ সময় এক ব্যক্তি অভিযোগ করলঃ ‘আল্লাহর কসম! আমি এ খবর রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অবশ্যই পৌঁছাব।’ সেমতে আমি তাঁর কাছে এসে উপরিউক্ত ব্যক্তির অভিযোগ পুনরুল্লেখ করলাম। এতে তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডল লাল বর্ণ ধারণ করল। তিনি (ক্ষোভের সাথে) বললেনঃ ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই যখন ন্যায়বিচার করে না, তখন আর কে ন্যায়বিচার করবে?’ এরপর বললেনঃ ‘আল্লাহ মূসা (আ) —এর প্রতি দয়া প্রদর্শন করুন। তাকে তো এর চাইতেও বেশি কষ্ট  দেয়া হয়েছে। তিনি ধৈর্য (সবর) অবলম্বন করেছেন।’ আমি (তাঁর অবস্থা দেখে) মনে মনে বললাম, এরপর আমি তাঁর কাছে এ ধরনের কোন অভিযোগ তুলবো না। (বুখারী ও মুসলিম)


৪৩. হযরত আনাস বর্ণনা করেন যে, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘আল্লাহ যখন তাঁর কোনো বান্দার ব্যাপারে কল্যাণ ইচ্ছা পোষণ করেন, তখন দুনিয়ায় তার প্রতি খুব শীঘ্র বালা-মুসিবত নাযিল করেন। অন্যদিকে তিনি যখন স্বীয় বান্দার জন্য অকল্যাণের ইচ্ছা পোষণ করেন, তখন তাকে গুনাহর মধ্যে ছেড়ে দেন। শেষ পর্যন্ত কিয়ামতের দিন তাকে পাকড়াও করবেন।’ রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেনঃ ‘(কোন কাজে) কষ্ট ক্লেশ বেশি হলে সওয়াবও বেশি হয়। আল্লাহ যখন কোনো জাতিকে ভালোবাসেন, তখন তাকে কঠিন বিপদে নিক্ষেপ করেন। যে ব্যক্তি এ বিপদ থেকে সন্তুষ্ট চিত্তে উত্তীর্ণ হবে, সে অবশ্যই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি এতে অসন্তুষ্ট হবে, তার জন্য থাকবে আল্লাহর অসন্তুষ্টি। ইমাম তিরমিযী বলেছেনঃ এটি হাসান হাদীস।


৪৪. হযরত আনাস (রা) বর্ণনা করেন, তিনি বলেনঃ আবু তাল্‌হা (রা)-এর এক পুত্র গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ল। আবু তালহা বাইরে কোথাও গিয়েছিলেন। তখন ছেলেটার মৃত্যু ঘটল। আবু তালহা ফিরে এসে ছেলেটার অবস্থা জানতে চাইলেন। ছেলের মা উম্মে সুলাইম বললেনঃ ‘আগের চাইতে সে ভাল’ এরপর তিনি আবু তালহাকে রাতের খাবার দিলেন। আবু তালহা খাবার খেলেন। তারপর স্ত্রীর সাথে মিলিত হলেন। মিলন শেষে উম্মে সুলাইম বললেনঃ ‘ছেলেটাকে দাফন করে দিন।’ (অর্থ্যাৎ সে মৃত্যুবরণ করেছে)।   আবু তালহা (রা) সকাল বেলা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে এ খবর দিলেন। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি কি আজ রাতে স্ত্রীর সাথে মিলিত হয়েছ? আবু তালহা (রা) বললেন ‘হ্যাঁ’।   রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ‘হে আল্লাহ! এদের দু’জনকে তুমি বরকত দান করো।’ এরপর উম্মে সুলাইমের একটি ছেলে জন্মগ্রহণ করল।

হযরত আনাস (রা) (এ হাদীসের বর্ণনাকারী) বলেনঃ আবু তালহা এ শিশুটিকে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে যেতে বলে এবং তার সাথে কিছু খেজুর পাঠিয়ে দিল। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমাদের সাথে কোনো খাবার জিনিস আছে কি? তিনি বললেনঃ ‘হ্যাঁ, কিছু খেজুর আছে।’ রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে খেজুর মুখে নিয়ে চিবোলেন। তারপর তা নিজের মুখ থেকে বের করে শিশুটির মুখে দিলেন এবং তার নাম রাখলেন আবদুল্লাহ। (বুখারী ও মুসলিম)

বুখারীর অপর এক বর্ণনা অনুসারে ইবনে ‘উয়াইনা বলেনঃ আনসারদের এক ব্যক্তি বললেন, আমি আবদুল্লাহর (আবু তালহার পুত্র) নয়টি সন্তান দেখেছি। তারা প্রত্যেকেই কুরআন সম্পর্কে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছে।

মুসলিমের এক বর্ণনায় আছেঃ আবু তালহার পুত্র ইন্তেকাল করলে তার মা উম্মে সুলাইম বাড়ির লোকদেরকে বললেন, তারা যেন আবু তালহাকে এ বিষয়ে কিছু না বলে। তাকে যা বলার, তিনি নিজেই তা বলবেন। আবু তালহা বাড়িতে এলে উম্মে সুলাইম তাকে রাতের খাবার দিলেন। তিনি তৃপ্তির সাথে পানাহার করলেন। তারপর উম্মে সুলাইম স্বামীর জন্য খুব সুন্দর করে সাজলেন। আবু তালহা তার সাথে মিলিত হলেন। উম্মে সুলাইম যখন দেখলেন, আবু তালহা পরিতৃপ্তি লাভ করেছেন এবং তার শারীরিক চাহিদা মিটে গেছে, তখন তাকে বললেনঃ হে আবু তালহা! শুনুন, যদি কোনো জনগোষ্ঠী কোনো পরিবারকে কিছু ঋণ দান করে, তারপর সেই ঋণ ফেরত চায়, তবে কি সেই পরিবার তাদের ঋণ ফেরত না দেয়ার অধিকার রাখে? জবাবে আবু তালহা বললেনঃ ‘না’।   তখন উম্মে সুলাইম বললেনঃ তাহলে আপনার ছেলের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করুন। আবু তালহা এ ব্যাপারে ভীষণ ক্ষুদ্ধ হলেন এবং বললেনঃ তুমি এ ব্যাপারে আগে কিছু বললে না! এমন কি, আমি দৈহিক মিলনের কাজও সেরে ফেললাম এবং তারপর তুমি ছেলে সম্পর্কে দুঃসংবাদ দিলে!

তিনি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে সব ঘটনা বর্ণনা করলেন। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দো’আ করলেনঃ ‘আল্লাহ তোমাদের দু’জনের রাতকে বরকতময় করুন।’ এরপর উম্মে সুলাইম গর্ভধারণ করলেন। পরবতীকালে কোনো এক সফরে তিনি (আবু তালহাসহ) রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহযাত্রী হলেন। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণত রাতের বেলায় সফর থেকে মদীনায় ফিরতেন না। যাই হোক, তারা যখন মদীনার কাছাকাছি এলেন, তখন উম্মে সুলাইম প্রসব বেদনা অনুভব করলেন। এ কারণে আবু তালহা তার সঙ্গে থেকে গেলেন এবং রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় ফিরে এলেন। বর্ণনাকারী আনাস (রা) বলেনঃ আবু তালহা বলতে লাগলেন; হে আল্লাহ! তুমি জান যে, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোথাও যান এবং কোথাও থেকে ফিরে আসেন, তখন তাঁর সহযাত্রী হতে আমার খুবই ভালো লাগে। আর এখন তো আমি এখানে যে কারণে ফেঁসে গেলাম তা তুমি দেখছ।’ উম্মে সুলাইম (রা) বলতে লাগলেনঃ ‘হে আবু তালহা! আমি যে ব্যাথা টের পাচ্ছিলাম সেটা এখন আর নেই। কাজেই চলুন, আমরা এখান থেকে মদীনা যাই।’ অতঃপর সেখান থেকে আমরা মদীনায় ফিরে এলাম।

মদীনায় আসার পর উম্মে সুলাইমের প্রসব বেদনা শুরু হলো এবং তিনি একটি পুত্র সন্তান প্রসব করলেন। হযরত আনাস (রা) বলেনঃ আমার আম্মা আমাকে বললেনঃ এ শিশুটিকে সকালে কেউ দুধ পান করানোর আগে তুমি একে নিয়ে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যেও। সেমতে সকালে আমি শিশুটিকে নিয়ে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম।’ এভাবে তিনি হাদীসটির বাকী অংশ বর্ণনা করেন।


৪৫. হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ  যে ব্যক্তি অন্যকে ধরে আছাড় মারে, সে শক্তিমান নয়; বরং শক্তিমান হলো সেই ব্যক্তি, যে ক্রোধের সময় নিজেকে সংযত রাখতে সক্ষম। (বুখারী ও মুসলিম)


৪৬. হযরত সুলাইমান ইবনে সুরাদ (রা) বর্ণনা করেন, আমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে বসা ছিলাম। এ সময় দুই ব্যক্তি পরস্পর বকাঝকা ও গালাগাল করছিল। তার মধ্যে একজনের চেহারা ক্রোধে লাল বর্ণ ধারণ করছিলে এবং তার ঘাড়ের শিরাগুলোও ফুলে উঠেছিল। তখন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আমি এমন একটি কথা জানি, যা বললে তার এই দুরবস্থা দূর হয়ে যাবে। সে যদি ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ্‌ শায়ত্বানির রাজীম’ বলে, তবে তার এই ক্রোধের আবেগ চলে যাবে। সাহাবীগণ তাঁকে বললেনঃ রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপরিউক্ত কথাটি (অর্থ্যাৎ আউযুবিল্লাহ) বলে তোমাকে অভিশপ্ত শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইতে বলেছেন। (বুখারী ও মুসলিম)


৪৭. হযরত মু’আয ইবনে আনাস (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি নিজের ক্রোধ প্রকাশের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাকে অবদমিত রাখে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাকে সব মানুষের চেয়ে অধিক মর্যাদার সাথে ডাকবেন। এমনকি তিনি নিজ পছন্দ মতো বড় বড় আয়াত-লোচনা সুন্দরী যুবতীদের (হুর) মধ্যে থেকে কাউকে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা পর্যন্ত দিবেন।

ইমাম আবু দাউদ ও ইমাম তিরমিযী এ হাদীসটি বর্ননা করেছেন এবং তিরমিযী একে হাসান আখ্যা দিয়েছেন।


৪৮. হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেনঃ এক ব্যক্তি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললঃ আমাকে কিছু উপদেশ দিন। তিনি বললেনঃ ‘রাগ করো না’ লোকটি বারবার কথাটি বলতে লাগল আর রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু বলতে লাগলেনঃ ‘রাগ করো না’। (বুখারী)


৪৯. হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ঈমানদার নর-নারীর জান-মাল ও সন্তানাদির উপর বিপদাপদ আসতেই থাকে। শেষ পর্যন্ত সে আল্লাহর সমীপে উপস্থিত হয় এমন অবস্থায় যে, তার আর কোন গুনাহই থাকে না।

ইমাম তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা প্রসঙ্গে একে হাসান ও সহীহ হাদীসরূপে বর্ণনা করেছেন।


৫০. হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণনা করেনঃ একদা উয়াইনা ইবনে হিসন মদীনায় এসে স্বীয় ভাতিজা হুর ইবনে কায়েসের মেহমান হলেন। হুর ইবনে কায়েস ছিলেন হযরত উমর (রা) এর ঘনিষ্ট জনদের অন্যতম। আর উমর (রা) –এর ঘনিষ্টজন ও উপদেষ্টগণ— তাঁরা যুবক বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবাই ছিলেন খুব কুরআন বিশেষজ্ঞ। উয়াইনা তার ভাতিজাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে ভাতিজা! তোমার তো আমিরুল মুমিনীনের কাছে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সুতরাং তাঁর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে আমার জন্য অনুমতি চাও। হুর অনুমতি চাইলেন এবং উমর (রা) তাতে সায় দিলেন। তিনি (হুর) তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, ‘হে ইবনে খাত্তাব! আল্লাহর কসম! আপনি আমাদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ দান করেন না এবং আমদের ব্যাপারে ইনসাফপূর্ণ হুকুমও জারি করেন না।’ এতে উমর বেশ ক্ষুদ্ধ হলেন, এমনকি তাকে প্রহার করতে উদ্যত হলেন। তখন হুর তাকে বললেনঃ ‘হে আমিরুল মুমিনীন! আল্লাহ তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলেছেনঃ ‘ক্ষমা প্রদর্শন করো, ভাল কাজের আদেশ দাও এবং মুর্খদের এড়িয়ে চলো।’ (সূরা আ’রাফঃ ১৯৯ আয়াত) আর ইনি তো মূর্খদের দলভূক্ত এক ব্যক্তি। আল্লাহর কসম! এ আয়াত তেলাওয়াত করার সময় উমর (রা) কোনো সীমা লঙ্ঘন করেননি। তাছাড়া তিনি কুরআনের শিক্ষা অনুযায়ী খুব বেশি কাজ করতেন। (বুখারী)


৫১. হযরত ইবনে মাসউদ (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ  আমার পরে খুব শীঘ্রই কারো উপর কাউকে গুরুত্ব দেয়া হবে এবং এমন সব কাজ সম্পন্ন হবে, যা তোমাদের পছন্দনীয় হবে না। সাহাবীগণ জানতে চাইলেন হে আল্লাহর রাসূল! এমতাবস্থায় আপনি আমদের কি আদেশ করেন? তিনি বললেনঃ ‘তোমাদের অন্যের ওপর যেসব হক রয়েছে, সেগুলো আদায় করো এবং তোমাদের পাওনা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো।’ (বুখারী ও মুসলিম)


৫২. হযরত আবু ইয়াহ্ইয়া উসাইদ ইবনে হুদাইর (রা) বর্ণনা করেন, একদা জনৈক আনসারী বললঃ হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি অমুকের ন্যায় আমাকে কেন কর্মচারী নিযুক্ত করবেন না? রাসূলে আকরাম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ‘তোমরা খুব শীঘ্রই আমার পরে (তোমাদের নিজেদের ওপর) অন্যের গুরুত্ব দেখতে পাবে। তখন আমার সাথে হাওযে কাউসারে সাক্ষাত না হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করবে।’ (বুখারী ও মুসলিম)


৫৩. হযরত আবু ইবরাহীম আবদুল্লাহ ইবনে আবু আওফা (রা) বর্ণনা করেনঃ একদিন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শত্রুদের সাথে যুদ্ধরত ছিলেন। যুদ্ধের মধ্যেই তিনি সূর্য হেলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এমনই অবস্থায় তিনি দাঁড়িয়ে বললেনঃ ‘হে জনমণ্ডলী! তোমরা শত্রুদের সাথে সংঘর্ষের আগ্রহ পোষণ করো না; বরং আল্লাহর কাছে শান্তি চাও। তবে যখন তাদের সাথে সংঘর্ষ লেগেই যাবে, তখন সবর করবে, অর্থ্যাৎ অবিচল ও দৃঢ়চিত্ত থাকবে। জেনে রাখো, জান্নাতের অবস্থান তলোয়ারের ছায়াতলে।’ অতঃপর রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ‘হে কিতাব অবতরণকারী; মেঘ চালনাকারী ও শত্রু বাহিনীকে পরাজয় দানকারী আল্লাহ! ওদেরকে পরাভুত করো এবং আমাদেরকে ওদের ওপর বিজয় দান করো।’ (বুখারী ও মাসলিম)


 

Was this article helpful?

Related Articles