ইহকালের প্রতি অনাসক্তির এবং পার্থিব সম্পদ কম অর্জনের উৎসাহ প্রদান এবং দরিদ্রতার ফযীলত সংক্রান্ত বর্ণনা

[Note: এ অধ্যায়ের কুরআনের আয়াত গুলো পরে আপডেট করা হবে]

 

৪৫৭. আমর ইবনে আওফ আনসারী (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) জিজিয়া আদায় করে আনার জন্য আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা) কে বাহরাইনে পাঠান। তিনি বাহরাইন থেকে ধন্তসম্পদ নিয়ে মদীনায় ফিরে এলেন। আনসাররা আবু উবায়দা (রা)-এর ফিরে আসার কথা শুনতে পেয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে ফজরের নামায পড়েন। রাসূলুল্লাহ (সা) নামায শেষ করলে তারা তাঁর সামনে উপস্থিত হলেন। তাঁদের দেখে রাসূলুল্লাহ (সা) মুচকি হেসে বলেনঃ আমার মনে হয়, তোমরা আবু উবাইদার বাহরাইন থেকে মাল নিয়ে ফিরে আসার সংবাদ শুনতে পেয়েছো? তাঁরা বলেন, হ্যাঁ, ইয়া রাসূলুল্লাহ! অতঃপর তিনি বলেনঃ তোমরা আনন্দিত হও, আর যে বস্তু তোমাদের খুশির কারণ হয় তার আশা কর। আল্লাহর শপথ! তোমাদের জন্য আমি দারিদ্র্যের ভয় করছি না, বরং এই ভয় করছি যে, পার্থিব প্রাচুর্য তোমাদের সামনে প্রসারিত করা হবে, যেরূপ তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য প্রসারিত করা হয়েছিল। অতঃপর তারা যেরূপ লালসা ও মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল, তোমরাও সেরূপ লালসাগ্রস্ত হয়ে পড়বে এবং এই পার্থিব প্রাচুর্য তাদের যেরূপ ধ্বংস করেছে, তোমাদেরকেও সেরূপ ধ্বংস করবে। (বুখারী, মুসলিম)


৪৫৮. আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) মিম্বারে বসলেন এবং আমরা তাঁর চারপাশে বসলাম। তিনি বলেনঃ আমার পরে যে বিষয়গুলো সম্পর্কে তোমাদের জন্য আমার ভয় হচ্ছে তা হলো, (বিভিন্ন দেশ জয়ের পর) তোমরা যে পার্থিব চাকচিক্য ও সৌন্দর্য লাভ করবে (অর্থাৎ বিভিন্ন দেশ জয়ের পর তোমাদের হাতে যখন প্রাচুর্য আসবে, তোমরা তখন পার্থিব বস্তুর পেছনে ধাবিত হবে, এটাই আমার বড় আশংকা)। (বুখারী, মুসলিম)


৪৫৯. আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ দুনিয়াটা একটা শ্যামল সবুজ সুমিষ্ট বস্তু। আল্লাহ এখানে তোমাদের প্রতিনিধি বানিয়ে পাঠিয়েছেন এবং তোমরা কী করছো তা দেখছেন। সুতরাং এ দুনিয়ায় (লোভ-লালসা থেকে) আত্মরক্ষা করো এবং স্ত্রীলোকের (ফিতনা) সম্পর্কে সতর্ক থাকো। (মুসলিম)


৪৬০. আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। নবী (সা) বলেনঃ “হে আল্লাহ! আখিরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন।“ (বুখারী, মুসলিম)


৪৬১. আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ তিনটি জিনিস মৃতের পেছনে পেছনে (কবর পর্যন্ত) যায়ঃ তার পরিজন, তার ধন্তসম্পদ ও তার আমল (নেক বা বদ)।  অতঃপর দু’টি ফিরে আসে এবং একটি (তার সাথে) থেকে যায়। তার পরিজন ও সম্পদ ফিরে আসে এবং তার আমল তার সাথে থেকে যায়।“ (বুখারী, মুসলিম)


৪৬২. আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা) বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন জাহান্নামীদের মধ্য থেকে দুনিয়াতে সর্বাধিক প্রাচুর্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে হাযির করা হবে এবং খুব জোরে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, অতঃপর তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, হে আদম সন্তান! তুমি কি কখনো কোনো কল্যাণ দেখছো, তুমি কি কখনো প্রাচুর্য দিন যাপন করেছো? সে বলবে, না, আল্লাহর শপথ! হে আমার রব। আবার জান্নাতীদের মধ্য থেকেও একজনকে হাযির করা হবে, যে দুনিয়াতে সবচাইতে দুর্দশা ও অভাবগ্রস্ত ছিল। অতঃপর তাকে খুব দ্রুত জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, অতঃপর জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি কি কখনো কোন অভাব দেখেছো, তুমি কি কখনো দুর্দশা ও অনটনের মধ্যে দিন যাপন করেছো? সে বলবে, “না, আল্লাহর শপথ! আমি কখনো অভাব অনটন দেখিনি এবং আমার উপর দিয়ে তেমন কোনো দুর্দশাও অতিবাহিত হয়নি। (মুসলিম)


৪৬৩. মুসতাওরিদ ইবনে শাদ্দাদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আখিরাতের তুলনায় ইহকালের দৃষ্টান্ত এরূপ যে, তোমাদের কেউ তার একটি আঙুল সমুদ্রে ডুবালে কতটুকু সাথে নিয়ে ফিরে তা দেখুক (অর্থাৎ আঙুলের অগ্রভাগে সমুদ্রের পানির যতটুকু পানি লেগে থাকে) সমুদ্রের তুলনায় তা যেমন কিছুই নয়, তেমনি আখিরাতের তুলনায় দুনিয়াও কিছুই নয়। (মুসলিম)


৪৬৪. জাবির (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বাজারের উপর দিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁর দু’পাশে ছিলেন সাহাবায়ে কেরাম। তিনি একটা কান কাটা মরা ছাগল ছানার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এর কান ধরে তাদের জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমাদের কেউ কি এক দিরহামের বিনিময়ে এটা কিনতে রাজি আছে? তারা বলেন, আমরা কোন কিছুর বিনিময়ে এটা কিনতে রাজি নই; আর আমরা এটা দিয়ে করবোই বা কি? তিনি পুনরায় বলেনঃ তোমরা কি বিনামূল্যে এটা নিতে রাজি আছো? তারা বলেন, আল্লাহর শপথ! এটা যদি জীবিতও থাকতো, তবুও ত্রুটিপূর্ণ; কেননা এটার কান কাটা। তাহলে মৃত অবস্থায় এর কি মূল্য হতে পারে? তিনি (রাসূল) বলেনঃ আল্লাহর কসম! তোমাদের কাছে এ ছাগল ছানাটা যেরূপ নিকৃষ্ট, দুনিয়াটা আল্লাহর কাছে এর চাইতেও বেশি নিকৃষ্ট। (মুসলিম)


৪৬৫. আবু যার (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী (সা)-এর সাথে মদীনার কালো কংকরময় প্রান্তরে হাঁটছিলাম। উহুদ পাহাড় আমাদের দৃষ্টিগোচর হলে তিনি বলেনঃ হে আবু যার! আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি আপনার খেদমতে হাযির আছি। তিনি বললেনঃ এই উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও যদি আমার হয় এবং তিন দিন অতীত হওয়ার পরও আমার কাছে তা থেকে আমার ঋণ আদায়ের অংশ ছাড়া একটি দীনারও অবশিষ্ট থাকে তবে তাতে আমি মোটেও খুশি হতে পারব না, যাবত না তা আমি আল্লাহর বান্দাদের মাঝে এভাবে, এভাবে ও এভাবে, ডানে-বাঁয়ে ও পেছনে খরচ করি। অতঃপর তিনি এগিয়ে চললেন এবং বললেনঃ বেশি সম্পদশালীরাই কিয়ামতের দিন নিঃস্ব হবে; কিন্তু যারা সম্পদ এভাবে, এভাবে ও এভাবে ডানে-বাঁয়ে ও পেছনে খরচ করেছে তারা ব্যতীত। তবে তাদের মধ্যে এ ধরনের লোকের সংখ্যা খুবই কম। অতঃপর তিনি আমাকে বলেনঃ আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত তুমি নিজের স্থান থেকে নড়বে না। অতঃপর তিনি রাতের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আমি একটা বিকট শব্দ শুনে ভয় পেয়ে গেলাম যে, নবী (সা)-এর উপর কোন অস্বাভাবিক কিছু ঘটে গেল কি না? কাজেই আমি তাঁর খোঁজে যাওয়ার ইচ্ছা করলাম, কিন্তু তার এ আদেশঃ “আমি না আসা পর্যন্ত তুমি নিজের স্থান থেকে নড়বে না “স্মরণ হয়ে গেলো এবং তাঁর ফিরে আসার পূর্ব পর্যন্ত আমি স্থান ত্যাগ করলাম না। আমি বললাম, আমি একটা বিকট শব্দ শুনে তাতে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি তাঁকে বললে তিনি বলেনঃ তুমি তাহলে সে শব্দ শুনেছো? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বলেনঃ এটা জিবরাঈলের শব্দ। তিনি আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি বলে গেলেনঃ তোমার উম্মাতের যে কেউ আল্লাহর সাথে শরীক না করে মারা যাবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আমি বললাম, সে যদি যেনা করে, সে যদি চুরি করে? তিনি বলেনঃ সে যদি যেনাও করে এবং চুরিও করে, তবুও।

ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম হাদীসটি রিওয়ায়েত করেছেন। তবে হাদীসের মূল পাঠ বুখারীর।


৪৬৬. আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আমার কাছে যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও থাকে এবং আমার ঋণ পরিশোধের সম-পরিমাণ ব্যতীত তিন দিন যেতে না যেতেই আমার কাছে এর কিছুই অবশিষ্ট না থাকে, তাহলে এতেই আমি আনন্দিত হবো। (বুখারী, মুসলিম)


৪৬৭. আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ তোমরা নিজেদের চাইতে নিম্ন মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির দিকে তাকাও এবং তোমাদের চাইতে উচ্চ মর্যাদাশীলের দিকে তাকিও না। তোমাদের উপর আল্লাহর দেয়া অনুগ্রহকে নিকৃষ্ট মনে না করার জন্য এটাই উৎকৃষ্ট পন্থা।

ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। হাদীসের মূল পাঠ সহীহ মুসলিমের। বুখারীর অপর বর্ণনায় আছেঃ তোমাদের কেউ তার চাইতে ধনী ও দৈহিক গঠনে সৌন্দর্যমণ্ডিত কোন ব্যক্তির দিকে তাকালে সে যেন তার চাইতে নিকৃষ্ট ব্যক্তির দিকেও তাকায় (তাহলে তাকে যা দেয়া হয়েছে তার মূল্য বুঝতে পারবে)।


৪৬৮. আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। নবী (সা) বলেছেনঃ দিনার, দিরহাম, কালো চাদর ও চওড়া পাড় পশমী চাদরের দাস ধ্বংস হোক। কেননা তাকে যদি দেয়া হয় তবে খুশি, কিন্তু না দেয়া হলেই বেজার। (বুখারী)


৪৬৯. আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি সত্তরজন আসহাবে সুফফাকে দেখেছি,৬১ যাদের কারো কোন চাদর ছিল না। কারো হয়তো একটি লুঙ্গী এবং কারো একটি কম্বল ছিল। তারা এটাকে নিজেদের গলায় বেঁধে রাখতেন। কারোরটা হয়তো তার পায়ের গোছার অধ্যাংশ পর্যন্ত পৌঁছতো; কারোরটা হাঁটু পর্যন্ত। লজ্জাস্থান উন্মুক্ত হওয়ার ভয়ে তারা হাত দিয়ে তা ধরে রাখতেন। (বুখারী)

*৬১. আসহাবে সুফফা সেসব বিদ্যোৎসাহী সাহাবীদের বলা হয়, যাঁরা বাড়িঘর ছেড়ে নবী (সা)-এর কাছ থেকে জ্ঞান সংগ্রহে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছিলেন। তাঁরা মসজিদে নববীর আঙ্গিনায় থাকতেন। যুদ্ধের দাক দেয়া হলে অংশগ্রহণ করতেন। মোটা পশমী কম্বল পরতেন। তাদের ভরণপোষণের জন্য নবী (সা)-এর উপরই দায়িত্ব ছিল। অত্যন্ত দীনহীন ও পবিত্র জীবন যাপনের জন্য ইসলামের ইতিহাসে তাঁরা বিশেষ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত।


৪৭০. আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ দুনিয়াটা হলো ঈমানদানদের জন্য কারাগার* এবং কাফেরদের জন্য জান্নাত। (মুসলিম)

* এর অর্থ এটা নয় যে, মু’মিনদেরকে শাস্তিস্বরূপ দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছে। বরং এর অর্থ হচ্ছে, কোনো ব্যক্তি কারাগারে যদি প্রথম শ্রেণীর সুযোগ-সুবিধাও লাভ করে তবুও সেখানে সে যেমন অবস্থান করতে চায় না বরং সবসময় সে তার আবাসস্থলে ফিরে যাওয়ার জন্য উন্মুখ থাকে, তেমনিভাবে একজন মু’মিন দুনিয়ার জীবনে যত সুখ-স্বাচ্ছন্দ ও অর্থ-বিত্তের মালিক হক না কেন, সবসময় সে তার আসল নিবাস জান্নাতে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব থাকে।


৪৭১. ইবনে উমার (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) আমার কাঁধ ধরে বললেনঃ দুনিয়াতে তুমি মুসাফির অথবা পথচারী হয়ে থেকো। তাই ইবনে উমার (রা) বলতেন, তুমি যখন সন্ধ্যায় উপনীত হও, তখন সকালের প্রতীক্ষা করো না, তুমি যখন সকালে উপনীত হও, তখন সন্ধ্যার প্রতীক্ষা করো না, সুস্থ থাকার সময় রোগের সময়ের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করো এবং তোমার জীবনকালে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করো। (বুখারী)

ইমাম নববী (র) বলেন, মুহাদ্দিসগণ উক্ত হাদীসের ব্যাখায় বলেছেন যে, এ হাদীসের অর্থ এই যে, তোমরা দুনিয়ার জীবনের প্রতি নিশ্চিন্ত হয়ে তাকে প্রকৃত আবাস হিসেবে গ্রহণ করো না এবং এখানে দীর্ঘকাল ধরে থাকতে পারবে বলে আশা পোষণ করো না। দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক হবে একজন বিদেশি পর্যটকের মত। সে বিদেশে যথাসম্ভব নিজের প্রয়োজন সেরে তার নিজ দেশে চলে যায়, তার পরিবার-পরিজনের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য।


৪৭২. আবুল আব্বাস সাহল ইবনে সা’দ আস-সা’য়েদী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী (সা)-এর কাছে এসে বললো, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন কোন কাজ বলে দিন, যখন আমি তা করবো তখন আল্লাহ আমাকে ভালোবাসবেন এবং মানুষও ভালোবাসবে। তিনি বলেন, তুমি দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত হও, আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন এবং মানুষের কাছে যা আছে, তার প্রতিও অনাসক্ত হও তাহলে মানুষও তোমাকে ভালোবাসবে।

হাদীসটি হাসান, ইমাম ইবনে মাজাহ প্রমুখ উত্তম সনদসহ বর্ণনা করেছেন।


৪৭৩. নু’মান ইবনে বাশীর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যেসব লোক পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ ও ধন-সম্পদ অর্জন করেছে, তাদের উল্লেখ করে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে দেখেছি, দিনভর তাঁর (নাড়িভূঁড়ি) পেঁচিয়ে থাকতো, অথচ তাঁর পেঁটে দেয়ার মত নিকৃষ্ট খেজুরও মিলতো না। (মুসলিম)


৪৭৪. আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ইন্তিকালের সময় আমার ঘরে এমন কোন বস্তু ছিল না যা কোন প্রাণী খেতে পারে। তবে আমার দেরাজে সামান্য কিছু যব মজুদ ছিল, অনেক দিন পর্যন্ত আমি তা থেকে খেতে থাকলাম। শেষে আমি তা ওজন করলাম এবং তা ফুরিয়ে গেলো। (বুখারী, মুসলিম)


৪৭৫. উম্মুল মু’মিনীন জুয়াইরিয়া বিনতুল হারিস (রা)-এর ভাই আমর ইবনুল হারিস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর ইন্তিকালের সময় কোন দীনার-দিরহাম, দাস-দাসী এবং অন্য সামগ্রী রেখে যাননি। তবে মাত্র তাঁর বাহন সাদা খচ্চরটি, তাঁর তরবারি এবং মুসাফিরদের জন্য দানকৃত কিছু ভূমি তিনি রেখে যান। (বুখারী)


৪৭৬. খাব্বাব ইবনুল আরাত (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে হিজরত করেছি। কাজেই এর সওয়াব আমরা আল্লাহর কাছে পাব। আমাদের মধ্যে কেউ এর বিনিময় ভোগ না করেই মারা গেছেন। তন্মধ্যে মুসআব ইবনে উমাইর (রা) উল্লেখযোগ্য। তিনি উহুদ যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর সম্পদের মধ্যে রেখে যান মাত্র একটি রঙীন পশমী চাদর। আমরা (কাফন দেবার জন্য চাদরটি দিয়ে) তাঁর মাথা ঢাকতে চাইলে তাঁর পা দু’টি অনাবৃত হয়ে যেতো এবং পা দু’টি ঢাকতে চাইলে তাঁর মাথা অনাবৃত হয়ে যেতো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর মাথা ঢেকে দিতে এবং তাঁর পায়ে ‘ইযখির’ ঘাস রেখে দিতে আমাদের আদেশ করেন। এখন আমাদের কারো কারো অবস্থা এরূপ যে, তার ফল পেকে রয়েছে এবং তিনি তা কেটে ভোগ করেছেন (অর্থাৎ ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের মধ্যে জীবন যাপন করছেন)। (বুখারী, মুসলিম)


৪৭৭. সাহল ইবনে সা’দ আস-সা’য়েদী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আল্লাহর কাছে পৃথিবীর মূল্য যদি মশার ডানার সমতুল্যও হতো, তাহলে তিনি কোন কাফির এক চুমুক পানিও পান করতে দিতেন না।

এ হাদীসটি তিরমিযী বর্ণনা করে বলেন, হাদীসটি হাসান ও সহীহ।


৪৭৮. আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে বলতে শুনেছিঃ জেনে রাখো, দুনিয়া ও তার মধ্যকার সব কিছুই অভিশপ্ত। কিন্তু আল্লাহ তা’আলার যিকির ও তিনি যা পছন্দ করেন এবং জ্ঞানী ও জ্ঞানার্জনকারী (অভিশপ্ত নয়)।

ইমাম তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করে বলেন, এটি হাসান হাদীস।


৪৭৯. আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ তোমরা জমিজমা ও ক্ষেত-খামার অর্জনের পেছনে লেগে যেও না, তাহলে তোমরা দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়বে।

ইমাম তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করে বলেন, হাদীসটি হাসান।


৪৮০. আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমরা একটি কুঁড়েঘর মেরামত করছিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ কী করা হচ্ছে? আমরা বললাম, এটা নড়বড়ে বা ভগ্নপ্রায় হয়ে গেছে, তাই আমরা তা মেরামত করছি। তিনি বলেনঃ আমি তো দেখছি কিয়ামত এর চাইতেও তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।৬২

আবু দাঊদ ও তিরমিযী, বুখারী ও মুসলিমের সনদে এ হাদীসটি বর্ণনা করেন। ইমাম তিরমিযী বলেন, হাদীসটি হাসান ও সহীহ।

*৬২. অর্থাৎ কুঁড়েঘরটি ভেঙ্গে পড়বে এবং তোমরা সেটি মেরামত করে তার মধ্যে থাকতে চাও। কিন্তু কুঁড়েঘরটি মেরামত করে তার মধ্যে অবস্থান করার আগেই কিয়ামত এসে যাচ্ছে। এ থেকে বুঝানো হচ্ছে, কিয়ামত অতি নিকটবর্তী। কাজেই দুনিয়ার ঘর মেরামত করার আগে আখিরাতের ঘর মেরামত করো।


৪৮১. কা’ব ইবনে ইয়াদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে বলতে শুনেছিঃ প্রত্যেক জাতির জন্য একটা ফিতনা (পরীক্ষার বস্তু) আছে। আমার উম্মাতের ফিতনা হলো সম্পদ। ইমাম তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করে বলেন, এটি হাসান ও সহীহ হাদীস।


৪৮২. আবু আমর উসমান ইবনে আফ্‌ফান (রা) (তাঁকে আবু আবদুল্লাহ ও আবু লায়লাও বলা হয়) থেকে বর্ণিত। নবী (সা) বলেছেনঃ তিনটি বস্তু ছাড়া আদম সন্তানের আর কিছুর অধিকার নেই। তাহলোঃ তার বসবাসের জন্য একটি ঘর; দেহ ঢাকার জন্য কিছু বস্ত্র এবং কিছু রুটি ও পানি।

ইমাম তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করে বলেন, এটি হাসান ও সহীহ হাদীস।


৪৮৩. আবদুল্লাহ ইবনুশ শিখখীর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে এসে দেখি, তিনি সূরা “আলহাকুমুত-তাকাসুর “(ধন-ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্য তোমাদেরকে আখিরাত ভুলিয়ে রেখেছে) পাঠ করছেন। অতঃপর তিনি বলেনঃ আদম সন্তানরা আমার সম্পদ, আমার ধন ইত্যাদি বলতে থাকে। অথচ হে বনী আদম! ততোটুকুই তোমার সম্পদ, যতোটুকু তুমি খেয়ে শেষ করেছো, পরিধান করে পুরনো করেছো এবং দান করে সঞ্চয় করেছো। (মুসলিম)


৪৮৪. আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী (সা) কে বললো, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আল্লাহর কসম, আমি নিশ্চয় আপনাকে ভালোবাসি। তিনি বলেনঃ তুমি কি বলছো তা ভেবে দেখ। সে বললো, আল্লাহর শপথ! নিশ্চয় আমি আপনাকে ভালোবাসি, এরূপ সে তিনবার বললো। অতঃপর তিনি বলেনঃ তুমি যদি আমাকে ভালোবাস, তাহলে দারিদ্র্যের জন্য মোটা পোশাক তৈরি করে নাও। কেননা, বন্যার পানি যে গতিতে তার শেষ গন্তব্যেও দিকে ধেয়ে যায়, আমাকে যে ভালোবাসে দারিদ্র্য তার চাইতেও দ্রুত গতিতে তার কাছে পৌঁছে যায়।

ইমাম তিরমিযী এ হাদীস বর্ণনা করে বলেন, হাদীসটি হাসান।


৪৮৫. কা’ব ইবনে মালিক (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ সম্পদ ও আভিজাত্যের প্রতি মানুষের লোভ তার দ্বীনের যে মারাত্মক ক্ষতি করে, বকরীর পালে ছেড়ে দেয়া দু’টি ক্ষুধার্ত নেকড়েও বকরীর পালের ততো ক্ষতি করতে পারে না।

ইমাম তিরমিযী এটি বর্ণনা করে বলেন, হাদীসটি হাসান ও সহীহ।


৪৮৬. আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) একটি চাটাইয়ের উপর শুয়ে ঘুমান। ঘুম থেকে উঠার পর আমরা তার শরীরে চাটাইয়ের দাগ দেখে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা যদি আপনার জন্য একটি তোষক বানিয়ে দিতাম! তিনি বলেনঃ দুনিয়ার সাথে আমার কি সম্পর্ক? আমি তো দুনিয়াতে এরূপ একজন মুসাফির, যে গাছের ছায়াতলে বিশ্রাম নেয়, অতঃপর তা ত্যাগ করে চলে যায়।

ইমাম তিরমিযী এ হাদীসটি বর্ণনা করে বলেন, হাদীসটি হাসান ও সহীহ।


৪৮৭. আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ দরিদ্ররা ধনীদের চাইতে পাঁচশো বছর আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

ইমাম তিরমিযী এ হাদীসটি বর্ণনা করে বলেন, হাদীসটি সহীহ।


৪৮৮. ইবনে আব্বাস ও ইমরান ইবনে হুসাইন (রা) থেকে বর্ণিত। নবী (সা) বলেনঃ আমি জান্নাতের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখলাম, তার অধিকাংশ অধিবাসীই দরিদ্র। আর জাহান্নামের তার অধিকাংশ অধিবাসীই নারী।

ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম উভয়ে ইবনুল আব্বাস (রা) থেকে হাদীসটি উদ্ধৃত করেন। ইমাম বুখারী ইমরান ইবনে হুসাইনের সূত্রেও এটি সংকলন করেন।


৪৮৯. উসামা ইবনে যায়েদ (রা) থেকে বর্ণিত। নবী (সা) বলেছেনঃ আমি জান্নাতের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখেছি, এতে প্রবেশকারীদের অধিকাংশই নিঃস্ব-দরিদ্র; আর সম্পদশালীদের আটকে রাখা হয়েছে (বেহেশতে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না)।  কিন্তু জাহান্নামীদের ইতিমধ্যেই জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। (বুখারী, মুসলিম)


৪৯০. আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। নবী (সা) বলেনঃ কবীরা যা বলেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সত্য কথা হল, নবীদের কথা, সে বলেছেঃ “মনে রেখ আল্লাহ ব্যতীত সব কিছুই বাতিল।“ (বুখারী, মুসলিম)।


 

Was this article helpful?

Related Articles