মহান আল্লাহ বলেনঃ
‘ওদেরকে জিজ্ঞেস করো, যে জানে আর যে জানে না, তারা উভয়ে কি কখনো সমান হতে পারে? বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরাই তো উপদেশ গ্রহণ করে থাকে।’ (সূরা আয যুমারঃ ৯)
৩৪৮. হযরত আবু মাসউদ উকবা ইবনে আমর বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি অপেক্ষাকৃত সৃন্দরভাবে কুরআন পড়ে, সেই লোকদের ইমামতি করবে। যদি কুরআন পাঠে সবাই সমান হয়, তবে যে অধিক হাদীস জানে (সুন্নাহ)। যদি হাদীসেও তারা সমান হয়, তবে যে প্রথমে হিজরত করেছে। যদি হিজরাতেও সমান হয় তবে যে অধিকতর বয়স্ক ব্যক্তি সে (ইমামতি করবে)। কোন ব্যক্তি যেন অপর কোন ব্যক্তির অধিকার ও প্রতিপত্তির এলাকায় ইমামতি না করে এবং তার বাড়িতে তার অনুমতি ছাড়া যেন সে তার সম্মানের স্থলে (নির্দিষ্ট আসনে) না বসে। (মুসলিম)
ইমাম মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় ‘বয়সের দিক থেকে অগ্রসর’ কথাটির স্থলে ইসলাম গ্রহণের দিক থেকে অগ্রসর কথাটি উল্লেখ রয়েছে। অপর এক বর্ণনায় আছেঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব অপেক্ষাকৃত সুন্দরভাবে পড়ে এবং কিরাআতের দিক থেকেও অগ্রসর, সেই লোকদের ইমামতি করে। যদি কিরাআতের দিক থেকেও তারা সমান হয় তবে হিজরতের দিক থেকে অগ্রসর ব্যক্তিই ইমামতি করবে। যদি তাতেও সমান হয়, তবে বয়োজেষ্ঠ্য ব্যক্তি লোকদের ইমামতি করবে।
৩৪৯. হযরত আবু মাসউদ উৎবা ইবনে আমর (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযের কাতারে আমাদের কাঁধে হাত রেখে বলতেনঃ সোজা হয়ে দাঁড়াও, বিভিন্ন রকমে কাতার বাঁকা করে দাঁড়াবে না; তাতে তোমাদের অন্তরগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে (অর্থ্যাৎ অন্তরে মতানৈক্যের সৃষ্টি হবে)। তোমাদের মধ্যকার বয়োজ্যেষ্ঠ ও বুদ্ধিমান লোকেরাই যেন আমার কাছাকাছি (প্রথম কাতারে) থাকে। এরপর যারা (বয়স ও বুদ্ধিতে) তাদের কাছাকাছি তারা, এরপর (উভয় বিষয়ে) যারা তাদের কাছাকাছি, তারা (দাঁড়াবে)। (মুসলিম)
৩৫০. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের মধ্যে যারা বয়োজ্যেষ্ঠ ও বুদ্ধিমান তারা যেন আমার কাছাকাছি (প্রথম কাতারে) দাঁড়ায়। এরপর যারা (বয়স ও বুদ্ধিতে) তাদের কাছাকাছি, তারা দাঁড়াবে। (তিনি তিনবার এ কথা বলেন) তিনি আরও বলেনঃ তোমরা মসজিদকে বাজারে পরিণত করা থেকে দূরে থাকো। (অর্থ্যাৎ মসজিদে বাজারের মতো হট্টগোল করো না) (মুসলিম)
৩৫১. হযরত আবু ইয়াহ্ইয়া কিংবা আবু মুহাম্মদ সাহল ইবনে আবু হাস্মা আল আনসারী (রা) বর্ণনা করেনঃ একদা আবদুল্লাহ ইবনে সাহল এবং মুহাইয়াসসা ইবনে মাসউদ খাইবার অঞ্চলে গেলেন। তখন খাইবারবাসী মুসলমানদের সাথে সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ ছিলেন। তারপর দু’জনে নিজ নিজ কাজে আলাদা হয়ে গেলেন। পরে মুহাইয়াসা আবদুল্লাহ ইবনে সাহলের কাছে এসে দেখেন, তিনি গুরুতরভাবে আহত হয়ে রক্তমাখা শরীরে গড়াগড়ি দিচ্ছেন। মৃত্যুর পর মুহাইয়াসা তাঁকে দাফন করে মদীনায় ফিরে এলেন। আবদুর রহমান ইবনে সাহল এবং মাসউদের দুই পুত্র মুহাইয়াসা ও হুয়াইয়াসা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলেন। আবদুর রহমান কথা বলতে উদ্যত হলে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ‘বয়োজ্যেষ্ঠকে বলতে দাও’, ‘বয়োজ্যেষ্ঠকে বলতে দাও’। আবদুর রহমান ছিলেন দলের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। তাই তিনি চুপ মেরে গেলেন। এরপর অন্য দু’জন মুহাইয়াসা ও হুয়াইয়াসা কথা বললেন। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘তোমরা কি হলফ করে বলতে পারবে, হত্যাকারী কে? তাহলে তোমরা রক্তপণের হকদার হবে।’ অতঃপর পূর্ব হাদীসটি বিবৃত করা হয়েছে। (বুখারী ও মুসলিম)
৩৫২. হযরত যাবের (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহুদের যুদ্ধে নিহত দু’জন শহীদকে একই কবরে দাফনের জন্যে নিচ্ছিলেন। এ পর্যায়ে তিনি জিজ্ঞেস করছিলেন, এ দু’জনের মধ্যে কে অধিক কুরআনে হাফেজ? যখন তাদের কোন একজনের প্রতি ইঙ্গিত করা হতো, তিনি তাকে কবরে আগে (ডানদিকে) রাখতেন।
৩৫৩. হযরত ইবনে উমর বর্ণনা করেন, একদা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আমি স্বপ্নে দেখলাম, আমি মেসওয়াক করছি। এ সময়ে দুই ব্যক্তি আমার কাছে এলো। তাদের মধ্যে একজন ছিল বয়সে অপরজনের চেয়ে বড়। আমি বয়সে ছোট ব্যক্তিকে মেসওয়াকটি দিলাম। আমাকে বলা হলো, বড়কে মেসওয়াকটি দিন। অতএব, আমি বয়স্ক ব্যক্তিকে মেসওয়াকটি দিলাম। (বুখারী ও মুসলিম)
৩৫৪. হযরত আবু মূসা (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বয়স্ক মুসলমানকে সম্মান করা, কুরআনের ধারক (অর্থ্যাৎ কুরআনের হাফেজ ও কুরআন বিশারদ) যদি তাতে (অর্থ্যাৎ কুরআনের শব্দ ও অর্থের মধ্যে) বাড়াবাড়ি কিছু না করে, তাকে সম্মান করা এবং ন্যায়নিষ্ঠ শাসককে সম্মান করা আল্লাহকে সম্মান করারই শামিল। (আবু দাউদ)
৩৫৫. হযরত আমর ইবনে শু’আইব এবং তার পিতা ও দাদার বর্ণনা মতে, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের স্নেহ ও দয়া করে না এবং আমাদের বড়দের মর্যাদা দেয় না, সে আমাদের মধ্যে শামিল নয়। (আবু দাউদ ও তিরমিযী) আবু দাউদের আরেকটি বর্ণনাঃ যে আমাদের বড়দের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়, (সে আমাদের মধ্যে শামিল নয়)।
৩৫৬. হযরত মাইমুন ইবনে আবু শু’আইব বর্ণনা করেন, একদা হযরত আয়েশা (রা)-এর সম্মুখ দিয়ে একটি ভিক্ষুক যাচ্ছিল। আয়েশা (রা) তাকে এক টুকরা রুটি খেতে দিলেন। এরপর তার সামনে দিয়ে সুবেশধারী একটি লোক যাচ্ছিল। আয়েশা (রা) তাকে বসিয়ে খাবার খাওয়াইলেন। এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেনঃ রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মানুষের পদ-পদবী অনুসারে তার সাথে ব্যবহার করো।’ (আবু দাউদ)
ইমাম আবু দাউদ এ হাদীসটি র্বণনা করে বলেছেনঃ হযরত আয়েশা (রা)-এর সাথে মাইমুনার দেখা হয়নি। ইমাম মুসলিম তাঁর সহীহ হাদীস গ্রন্থে একে মু’আল্লাক হাদীসরূপে বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণনা মতে হযরত আয়েশা (রা) বলেনঃ রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের পদ-পদবী অনুসারে তার সাথে ব্যবহার করার জন্য আমাদের হুকুম দিয়েছেন। ইমাম হাফেজ আবু আবদুল্লাহ তার ‘মারেফাতে উলুমিল হাদীস’ গ্রন্থে এ হাদীসটি উল্লেখ করে বলেছেনঃ এটি সহীহ হাদীস।
৩৫৭. হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণনা করেন, একদা উয়াইনা ইবনে হিস্ন (মদীনায়) এল। সে তার ভাইপো হুর ইবনে কায়েসের মেহমান হলো। হুর ইবনে কায়েস উমর (রা)-এর ঘনিষ্ট লোকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখন যুবক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে কুরআনবিদগণ ও উমর (রা) এর পরিষদবর্গ ও উপদেষ্টা পরিষদ (মজলিশে শূরা) এর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। উয়াইনা তার বাইপোকে বললোঃ ‘হে ভাতিজা! এই আমীর (উমর) পর্যন্ত তোমার অবাধে পৌঁছার অধিকার রয়েছে। সুতরাং তার সঙ্গে দেখা করার জন্য আমাকে একটু অনুমতি নিয়ে দাও। উয়াইনা তার কাছে অনুমতি চাইলেন। উমর (রা) তাকে অনুমতি দিলেন। ওয়াইনা তার কাছে পৌঁছে বললো হে খাত্তাবের পুত্র! আল্লাহর কসম! তুমি না আমাদের বাড়তি কিছু দাও আর না আমাদের মধ্যে ইনসাফের সাথে ফায়সালা করো।’ একথায় উমর (রা) খুব ক্রুদ্ধ হলেন, এমনকি তাকে কিছুটা মারধোর করারও ইচ্ছা করলেন। তখন হুর তাকে বললঃ হে আমিরুল মুমিনীন! আল্লাহ তাঁর নবী মুহাম্মদ আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেনঃ হে নবী! নম্রতা ও মার্জনার নীতি অনুসরণ করো। সৎকাজের নির্দেশ দাও এবং মূর্খ লোকদের সাথে জড়িয়ে পড়ো না; বরং তাদেরকে এড়িয়ে চল। (সূরা আল আ’রাফঃ ১৯৯)। হুর বলেনঃ ‘এ ব্যক্তি মূর্খ লোকদেরই একজন।’ আল্লাহর কসম! উমর এই আয়াত ছেড়ে মোটেই সামনে এগোননি; কেননা তিনি আল্লাহর কিতাবের সবচেয়ে বেশি অনুগত ছিলেন। (বুখারী)
৩৫৮. হযরত সামুরা ইবনে জুনদুব (রা) বর্ণনা করেন, আমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যমানায় অল্প বয়স্ক বালক ছিলাম। আমি তাঁর কাছ থেকে হাদীস মুখস্ত করতাম। সেসব হাদীস বর্ণনা করার ব্যাপারে আমার তেমন কোন বাধা ছিল না। শুধুমাত্র একটি বাধা ছিল; আর তা হলো এখানে এমন কিছু সংখ্যক লোক ছিলেন যারা বয়সে আমার চেয়ে অগ্রসর। (তাদের সামনে হাদীস বর্ণনা করতে আমি সঙ্কোচ বোধ করতাম)। (বুখারী ও মুসলিম)
৩৫৯. হযরত আনাস (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যদি কোন তরুণ কোন বয়স্ক লোককে তার বার্ধক্যের দরুণ সম্মান প্রদর্শন করে, তবে আল্লাহও তার বৃদ্ধ বয়সে এমন লোক নির্দিষ্ট করে দেবেন, যে তাকে সম্মান করবে। (তিরমিযী)