দুর্বল ও গরীব মুসলমানদের ফযীলত
মহান আল্লহ বলেনঃ
‘তোমাদের হৃদয়কে এমন লোকদের সংস্পর্শে স্থিতিশীল রাখো, যারা নিজেদের প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সকাল-সন্ধ্যায় তাঁকে ডাকে। আর তাঁদের দিক থেকে কখনো তোমরা অন্যদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করোনা।’ (সূরা আল কাহাফঃ ২৮)
২৫২. হযরত হারিসা ইবনে ওয়াহাব (রা) বর্ণনা করেনঃ আমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছিঃ কোন্ ধরনের লোক জান্নাতী হবে, আমি কি তা তোমাদের বলব না? যে দুর্বল ব্যক্তিকে লোকেরা শক্তিহীন ও তুচ্ছ জ্ঞান করে, সে যদি আল্লাহর ওপর হলফ করে ভরসা করে, তবে আল্লাহ তা পূরণ করার সুযোগ দেবেন। কোন্ ধরনের লোক জাহান্নামে যাবে আমি কি তা তোমাদের বলব না? (জেনে রাখো)! প্রতিটি নাদান, অবাধ্য ও অহংকারী ব্যক্তিই জাহান্নামে যাবে। (বুখারী ও মুসলিম)
২৫৩. হযরত সাহল ইবনে সা’দ (রা) বর্ণনা করেনঃ এক ব্যক্তি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তিনি তাঁর কাছে বসা লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেনঃ (চলে যাওয়া) লোকটি সম্পর্কে তোমার কি অভিমত? জবাবে সে বললঃ ‘তিনি তো শরীফ লোকদের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর কসম! তিনি খুবই যোগ্য লোক। তিনি বিয়ের প্রস্তাব দিলে তা কবুল করা হয় এবং তাঁর সুপারিশও গ্রহণ করা হয়। (কোন মন্তব্য না করে) রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নীরব রইলেন। এরপর অন্য এক ব্যক্তি তাঁর সামনে দিয়ে অতিক্রান্ত হলো। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসা লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেনঃ এ লোকটি সম্পর্কে তোমার কি ধারণা? সে জবাবে বললঃ হে আল্লাহর রাসূল! এ লোকটি তো গরীব মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত। তার অবস্থা এই যে, তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তা প্রত্যাখ্যাত হয়, তার সুপারিশ কবুল করা হয় না এবং কোন কথা বললে তাকে কেউ গুরুত্ব দেয় না। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এই লোকটি নিঃস্ব মুসলমান হলেও দুনিয়ায় ঐসব (তথাকথিত শরীফ) লোকদের চেয়ে অনেক উত্তম। (বুখারী ও মুসলিম)
২৫৪. হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ বেহেশত এবং দোযখ এই দুইয়ের মধ্যে বিতর্ক হলো। দোযখ বলল, আমার ভেতর বড় বড় জালিম, দাম্ভিক ও অহংকারী লোকেরা রয়েছে। বেহেশত্ বলল, আমার ভেতর রয়েছে গরীব, দুর্বল ও অসহায় লোকেরা। মহান আল্লাহ উভয়ের মধ্যে ফায়সালা করে দিলেনঃ বেহেশত্ তুমি আমার রহমতের আধার। তোমার মাধ্যমে যার প্রতি ইচ্ছা অনুগ্রহ প্রদর্শন করবো। আর দোযখ! তুমি আমার শাস্তির আধার। তোমার মাধ্যমে যাকে ইচ্ছা আমি শাস্তি দেব। তোমাদের উভয়কে পূর্ণতা দানই আমার কাজ। (মুসলিম)
২৫৫. হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ কিয়ামতের দিন এক মোটা-তাজা ও দীর্ঘদেহী ব্যক্তিকে উপস্থাপন করা হবে। কিন্তু আল্লাহর কাছে লোকটির মূল্য ও মর্যাদা একটি মাছির ডানার সমতুল্যও হবে না। (বুখারী ও মুসলিম)
২৫৬. হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেন, জনৈক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা (অথবা বর্ণনাকারীর সন্দেহ, এক যুবক) মসজিদে নববীতে ঝাড়ু দেওয়ার কাজ করত। একদিন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখতে না পেয়ে সাহাবীদের কাছে তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তাঁরা বললেন, সেই লোকটি মারা গেছে। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমরা আমাকে এ খবর দাওনি কেন? (সম্ভবত তারা এটাকে মামুলী ব্যাপার মনে করেছিলেন।) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আমাকে তার কবর দেখিয়ে দাও। লোকেরা তাঁকে কবরের কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি লোকটির জানাযা পড়লেন এবং বললেনঃ এই কবরবাসীদের কবরগুলো অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকতো। তাদের জন্য আমার নামায পড়ার কারণে আল্লাহ তায়ালা কবরগুলোকে আলোকিত করে দিয়েছেন। (বুখারী ও মুসলিম)
২৫৭. হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেছেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ এমন অনেক লোক রয়েছে যাদের মাথার চুল উস্কো-খুস্কো এবং পা দু’টি ধূলি ধূসরিত; তাদেরকে মানুষের দরজা থেকে ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়; কিন্তু তারা যদি আল্লাহর নামে শপথ করে তবে আল্লাহ তাদের সেই শপথ পূর্ণ করার তৌফিক দেন। (মুসলিম)
২৫৮. হযরত উসামা (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আমি মিরাজ-এর রাতে জান্নাত এর দরজায় দাঁড়ালাম। দেখলাম জান্নাতে প্রবেশকারী অধিকাংশ লোকই নিঃস্ব, দরিদ্র। বিত্তবান লোকদের জান্নাতে প্রবেশ করতে বাঁধা দেওয়া হচ্ছে। দোযখীদের দোযখে নিয়ে যাওয়ার হুকুম আগেই দেওয়া হয়েছিল। আমি দোযখের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, দোযখে প্রবেশকারীদের অধিতাংশই হচ্ছে মহিলা। (বুখারী ও মুসলিম)
২৫৯. হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ বনী ইসরাঈলদের মধ্যে তিন ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ দোলনায় কথা বলেনি। (এক) ঈসা ইবনে মরিয়ম এবং (দুই) সাহেবে জুরাইজ। জুরাইজ একজন খোদাভীরু বান্দা ছিলেন। তিনি নিজের জন্য একটি খানকাহ্ তৈরি করে সেখানেই বাস করতেন। একদিন সেখানে তার মা এসে উপস্থিত হলেন। এই সময় তিনি নামাযে মগ্ন ছিলেন। তার মা তাকে ডাকলেনঃ তখন তিনি মনে মনে বললেনঃ হে প্রভু! একদিকে আমার মা এবং অন্যদিকে আমার নামায তবে তিনি নামাযেই রত থাকলেন। পরদিন এসেও মা তাকে নামাযরত অবস্থায় পেলেন। তিনি ডাকলেনঃ হে জুরাইজ! তিনি বললেনঃ হে প্রভু! একদিকে আমার মা এবং আমার নামায। তিনি তার নামাযে ব্যস্ত রইলেন। তার মা বললেনঃ হে আল্লাহ! একে তুমি ব্যভিচারী নারীর মুখ না দেখা পর্যন্ত মৃত্যু দিও না।
বনী ইসরাঈলদের মধ্যে জুরাইজ ও তার বন্দেগীর চর্চা হতে লাগল। লোকদের মধ্যে চরিত্রহীন এক নারী ছিল। সে অত্যন্ত রূপ-সৌন্দর্যের অধিকারী ছিল। সে দাবী করলো, তোমরা যদি চাও, তাহলে আমি জুরাইজকে চরিত্রহীন করতে পারি। সে তাকে ফুঁসলাতে লাগল। কিন্তু তিনি সেদিকে কিছুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করলেন না। এরপর সে তার খানকার কাছাকাছি অবস্থিত এক রাখালের কাছে এল। সে নিজেকে তার কাছে সোপর্দ করল এবং উভয়ে ব্যভিচারে লিপ্ত হলো। এতে সে গর্ভবতী হলো। অতঃপর সে একটি সন্তান প্রসব করে বললোঃ এটা জুরাইজের ফসল। বনী ইসরাঈলেরা ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে খানকাহ্ থেকে বের করে মারধর করল এবং খানকাহটিকে ধূলিস্মাৎ করে দিল। জুরাইজ প্রশ্ন করলেন, তোমাদের কি হয়েছে? তোমরা এরূপ কেন করছো? তারা ক্রুদ্ধস্বরে বললো, তুমি এই বেশ্যার সাথে ব্যভিচার করেছো। ফলে একটি শিশু জন্মলাভ করেছে। তিনি প্রশ্ন করলেন শিশুটি কোথায়? তারা শিশুটিকে নিয়ে এলো। জুরাইজ বললেন আমাকে নামায পড়ার একটু সুযোগ দাও। তিনি নামায পড়লেন এবং তারপর শিশুটিকে নিয়ে নিজের কোলে বসালেন। তিনি শিশুটিকে জিজ্ঞেস করলেনঃ ওহে! তোমার পিতা কে? সে বললোঃ আমার পিতা অমুক রাখাল। উপস্থিত লোকেরা তখন জুরাইজের দিকে মনোযোগী হলো এবং তাকে চুম্বন করতে লাগল। তারা প্রস্তাব করলোঃ এখন আমরা তোমার খানকাহটি সোনা দিয়ে তৈরি করে দিচ্ছি। তিনি বললেনঃ তার কোন দরকার নেই; বরং পূর্বের মতো মাটি দিয়েই তৈরি করে দাও। এরপর তারা খানকাহটি পুনঃনির্মাণ করে দিল।
(তিন) একদা একটি শিশু তার মায়ের দুধ পান করছিল। এমন সময় একটি লোক অত্যন্ত দ্রুতগামী ও উন্নত জাতের একটি পশুতে সওয়ার হয়ে সেখান দিয়ে যাচ্ছিলো। তার পোশাক-আশাকও ছিল খুব উঁচু মানের। শিশুটির মা নিবেদন করলঃ হে আল্লাহ! আমার ছেলেটিকে এই ছেলেটির মতো যোগ্য করে দাও। শিশুটি দুধ পান ছেড়ে দিয়ে লোকটার দিকে গভীরভাবে তাকাল। তারপর বললোঃ হে আল্লাহ! আমাকে এই লোকটির মতো করো না। (বর্ণনাকারী বললেনঃ) আমি যেন এখনও দেখতে পাচ্ছি, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুটির দুধ পানের চিত্র তুলে ধরছেন এবং তর্জনী মুখে দিয়ে চুষছেন। তিনি (রাসূল) বললেনঃ লোকেরা একটি বাঁদীকে মারতে মারতে নিয়ে যাচ্ছিলো আর বলছিল, তুমি চুরি ও ব্যভিচার করেছো। অন্যদিকে বাঁদী মেয়ে লোকটি বলছিল যে, আল্লাহ আমার জন্য যথেষ্ট এবং তিনি আমার সর্বোত্তম অভিভাবক। শিশুটির মা বললঃ হে আল্লাহ তুমি আমার সন্তানকে এ ভ্রষ্টা নারীর কবল থেকে বাঁচাও। শিশুটি দুধপান ছেড়ে দিয়ে মেয়ে লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল, হে আল্লাহ! আমাকে এই মেয়ে লোকটির মতো বানাও। এই সময় মা ও শিশু পরস্পরে কথা বলা শুরু করল। মা বললো, একটি সুন্দর, সুপুরুষ চলে যাওয়ার সময় আমি বললামঃ হে আল্লাহ! আমার সন্তানকে এরূপ যোগ্য করে তোল। তুমি জবাবে বললে, হে আল্লাহ! আমাকে এর মতো বানিও না। আবার এই ক্রীতদাসীকে লোকেরা মারধর করতে করতে নিয়ে যাচ্ছে এবং বলছে, তুমি চুরি ও ব্যভিচারের মতো খারাপ পাপাচার করেছো। আমি বললাম, হে আল্লহ! আমার সন্তানকে এরূপ বানিও না। তুমি বললে, আমাকে এরূপ বানাও। শিশুটি এবার জবাব দিল, প্রথম ব্যক্তি ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও জালিম। সেজন্য আমি বললাম, হে আল্লাহ! আমাকে এর মতো বানিও না। আর এই মেয়েটিকে তারা বলল, তুমি খারাপ কাজ করেছ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে খারাপ কাজ করেনি। তারা এও অভিযোগ করল, তুমি চুরি করেছো। কিন্তু আসলে সে চুরি করেনি। এই জন্যই আমি বললাম, হে আল্লাহ! আমাকে এই মেয়ে লোকটির মতো বানাও। (বুখারী ও মুসলিম)