মহান আল্লাহ বলেনঃ
(হে নবী!) তুমি এ দুনিয়ার দ্রব্য-সামগ্রীর দিকে চোখ তুলে তাকাবে না, যা আমরা বিভিন্ন লোককে দিয়ে রেখেছি। আর না এদের অবস্থার জন্য নিজের অন্তরে কষ্ট অনুভব করবে; বরং এদের পরিবর্তে ঈমানদার লোকদের প্রতি তোমার দয়া-অনুগ্রহের হাত বাড়িয়ে রাখবে। (সূরা হিজরঃ ৮৮)
মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ
(হে নবী!) তোমার হৃদয়কে এমন লোকদের সংস্পর্শে স্থির রাখো যারা নিজেদের প্রভুর সন্তুষ্টি লাভের লক্ষ্যে সকাল-সন্ধ্যায় তাঁকে ডাকে। আর (তুমি) দুনিয়ার চাকচিক্যের আশায় তাদের দিক থেকে কখনো অন্যদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করো না। (সূরা আল কাহাফঃ ২৮)
মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ
অতএব (তুমি) ইয়াতিমদের প্রতি রুঢ় ব্যবহার করো না। কোন প্রার্থনাকারীকেও ধমক দিও না। (সূরা দোহা ৯-১০)
মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ
(হে নবী!) তুমি কি তাদের দেখেছো, যারা প্রতিফল দিবসকে (কিয়ামতকে) মিথ্যা মনে করে? তারা হলো সেই সব লোক, যারা ইয়াতীমকে (গলা) ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেয় এবং মিসকিনকে খাবার দিতে নিরুৎসাহিত করে। (সূরা মাউনঃ ১-৩)
২৬০. হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস বর্ণনা করেনঃ একদা আমরা ছয় ব্যক্তি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলাম। তখন মুশরিকরা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললোঃ এই লোকগুলোকে আপনার নিকট থেকে তাড়িয়ে দিন। তাহলে তারা আমাদের ওপর মাতব্বরী করতে পারবে না। আমরা ছিলামঃ (ছয় ব্যক্তি) আমি (সা’দ), ইবনে মাসউদ, হুযাইল গোত্রের এক ব্যক্তি বিলাল এবং অন্য দু’ব্যক্তি, যাদের নাম আমার স্মরণ নেই। আল্লাহর ইচ্ছায় রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্তরে কিছু কথার উদয় হলো। সে কারণে তিনি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। ইতোমধ্যে আল্লাহর তরফ থেকে ওহী নাযিল হলোঃ ‘যারা আপন প্রভুকে দিন-রাত ডাকতে থাকে এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ব্যস্ত থাকে, তাদেরকে তোমার নিকট থেকে দূরে সরিয়ে দিও না। তাদের হিসাবের কোন জিনিসের দায়িত্ব তোমার ওপর বর্তায় না এবং তোমার হিসাবেরও কোন জিনিসের বোঝা তাদের উপর ন্যাস্ত নয়। এতৎসত্ত্বেও তুমি যদি তাদেরকে দূরে সরিয়ে দাও তবে তুমি জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা আন’আমঃ ৫২) (মুসলিম)
২৬১. হযরত আবু হুরাইরা আয়েশা ইবনে ‘আমর আল মুযানী বর্ণনা করেন, তিনি বাইয়াতে রিয্ওয়ানে অংশগ্রহণকারী একজন সাহাবী ছিলেন। একদা আবু সুফিয়ান কতিপয় লোকের সাথে সালমান ফারসী (রা), সুহাইব রুমী (রা) ও বিলাল (রা) এর কাছে এলেন। তারা বললেন, আল্লাহর তরবারি আল্লাহর শত্রুদের কাছ থেকে প্রাপ্য হক আদায় করেনি? হযরত আবু বকর (রা) বললেন, তোমরা কুরাইশ শেখ এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সম্পর্কে এরূপ কথা বলছো? তিনি (আবু বকর) রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে তাঁকে এ বিষয়ে অবহিত করলেন। তিনি বললেনঃ হে আবু বকর! তুমি হয়তো তাঁদেরকে নাখোশ করেছো। যদি তুমি তাঁদেরকে (বিলাল, সালমান ও সুহাইব কে) নাখোশ করে থাকো, তবে তুমি তোমার প্রভুকেই নাখোশ করলে। অতঃপর তিনি (আবু বকর) তাদের কাছে ফিরে এসে বললেনঃ হে ভাই সকল! আমি কি তোমাদের নাখোশ করেছি? তারা বললেনঃ না হে ভাই! আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। (মুসলিম)
২৬২. হযরত সাহ্ল ইবনে সা’দ (রা) এর মতে, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ আমি ও ইয়াতীমদের অভিভাবকরা জান্নাতে এভাবে থাকবঃ (এ কথা বলে) তিনি স্বীয় তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করলেন এবং দু’য়ের মাঝখানে ফাঁক রাখলেন। (বুখারী)
২৬৩. হযরত আবু হুরাইরা (রা)-এর বর্ণনা মতে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ইয়াতীমদের লালনকারী তার নিকটাত্মীয় বা দূরাত্মীয় মুসলমানদের দেখা-শুনার দায়িত্ব আমার। তারা উভয়ে (ইয়াতীম ও তার নিকটাত্মীয়রা) বেহেশতে এভাবে থাকবেঃ আনাস ইবনে মালিক (রা) হাদীসটি বর্ণনা করার সময় তার নিজের তর্জনী ও মধ্যমা অঙ্গুলি দিয়ে ইঙ্গিত করে বিষয়টি বুঝালেন। (মুসলিম)
২৬৪. হযরত আবু হুরাইরা (রা) এর বর্ণনা মতে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ এমন ব্যক্তি মিসকিন নয়, যাকে একটি কিংবা দুটি খেজুর দেওয়া হয়, এ লোকমা (মুঠো) কিংবা দুই লোকমা খাবার দেওয়া হয় (অর্থ্যাৎ খুবই সামান্য দেয়া হয়, কিন্তু আদৌ বেশি দেওয়া হয় না)। বরং যে ব্যক্তি দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হয়েও অন্যের কাছে হাত পাতে না, সে-ই হলো মিসকিন। (বুখারী ও মুসলিম)
বুখারী ও মুসলিমের অপর একটি বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ এমন ব্যক্তি মিসকিন নয়, যে দু’এক মুঠো খাবার কিংবা দু’একটি খেজুরের জন্য লোকের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায় এবং তা দেয়া হলেই সে ফিরে চলে যায়; বরং প্রকৃত মিসকিন হলো সেই ব্যক্তি, যার প্রয়োজন পূরণের মতো যথেষ্ট সামর্থ নেই; অথচ (মুখ বুঁজে থাকার দরুণ) তাকে চেনাও যায় না, যাতে লোকেরা তাকে দান-খয়রাত করতে পারে এবং তার নিজেরও কারো কাছে হাত পাতার প্রয়োজন হয় না।
২৬৫. হযরত আবু হুরাইরা (রা) রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেনঃ বৃদ্ধ, বিধবা ও মিসকীনদের সাহায্যার্থে চেষ্টা-সাধনাকারী আল্লাহর পথে জিহাদকারীর সমতুল্য। বর্ণনাকারী বলেন, আমার ধারণা, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা বলেন যে, সে অবিরাম নামায আদায়কারী ও প্রতিদিন রোযা পালনকারী ব্যক্তির সমকক্ষ। (বুখারী ও মুসলিম)
২৬৬. হযরত আবু হুরাইরা (রা)-এর বর্ণনা মতে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ এমন ওয়ালিমা (বিবাহোত্তর ভোজ) হচ্ছে নিকৃষ্ট, তাতে যারা আসতে চায়, তাদেরকে বাধা দেয়া হয় আর যারা আসতে চায় না, তাদেরকে দাওয়াত করা হয়। যে ব্যক্তি দাওয়াত গ্রহণে অনিচ্ছা ব্যক্ত করল, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানি করল। (মুসলিম)
বুখারী ও মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ সবচেয়ে নিকৃষ্ট ওয়ালিমা হচ্ছে তা, যাতে ধনীদের দাওয়াত করা হয় এবং গরীবদের বর্জন করা হয়।
২৬৭. হযরত আনাস (রা) বর্ণনা করেন, হযরত আবু হুরাইরা (রা) এর বর্ণনা মতে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি দুটি মেয়েকে বালেগ হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করে, কিয়ামতের দিন সে এরূপ অবস্থায় আসবে যে, আমি আর সে এ রকম থাকবো। (এরপর তিনি নিজের আঙ্গুলসমূহ মিলিয়ে দেখালেন।) (মুসলিম)
২৬৮. হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করেনঃ একদা আমার কাছে এক মহিলা এলো। তার সাথে তার দুটি মেয়েও ছিল। মহিলাটি (আমার কাছে) কিছু চাইছিল। কিন্তু তখন আমার কাছে একটি খেজুর ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আমি তাকে খেজুরটা দিলাম। সে তা নিজের দুই মেয়ের মধ্যে ভাগ করে দিল। কিন্তু সে নিজে তা থেকে কিছুই খেল না। এরপর সে উঠে চলে গেল। এ সময় রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে এলেন। আমি তাঁকে বিষযটা খোলামেলা জানালাম। তিনি বললেনঃ যে ব্যক্তি এভাবে নিজের মেয়েদের নিয়ে পরীক্ষার মুখোমুখি হবে এবং তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করবে, কিয়ামতের দিন তারা তার জন্য (মেয়রা) দোযখের আগুনের বিরুদ্ধে প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়াবে। (বুখারী ও মুসলিম)
২৬৯. হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করেনঃ একদা এক গরীব মহিলা তার দুটি মেয়েসহ আমার কাছে এল। আমি তাদেরকে তিনটি খেজুর খেতে দিলাম। মহিলাটি তার মেয়ে দুটিকে একটি করে খেজুর দিল এবং একটি খেজুর নিজে খাওয়ার জন্য নিজের মুখের দিকে তুলল। কিন্তু সেটিও তার মেয়েরা খেতে চাইলো। তাই যে খেজুরটি সে নিজে খেতে চেয়েছিল, সেটিকেও সে দু’ভাগ করে নিজের মেয়ে দুটিকে দিয়ে দিল। (হযরত আয়েশা (রা) বলেনঃ) ব্যাপারটি আমায় হতবাক করে দিল। তার এই কাণ্ডের ব্যাপারটা আমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে খুলে বললাম। সব শুনে তিনি বললেনঃ আল্লাহ এর বিনিময়ে তার জন্য জান্নাত নির্ধারণ করে দিয়েছেন কিংবা বলা যায়, তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেছেন। (মুসলিম)
২৭০. হযরত আবু শুরাইহ্ খুওয়াইলিদ ইবনে ‘আমর আল-খুযাঈ (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘হে আল্লাহ! দুই দুর্বল ব্যক্তি অর্থ্যাৎ ইয়াতীম ও নারীদের প্রাপ্য বা অধিকার যে ব্যক্তি নষ্ট করে, আমি তার জন্যে অন্যায় ও অপরাধ (অর্থ্যাৎ গুনাহ) নির্ধারণ করে দিলাম। (নাসাঈ)
২৭১. হযরত মুসআ’ব ইবনে সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা) বর্ণনা করেনঃ একদিন সা’দ অনুভব করলেন, অন্যদের ওপর তার একটা শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমরা কেবল তোমাদের মধ্যকার দুর্বলদের কারণেই (আল্লাহর) সাহায্য ও রিযিক পেয়ে থাকো। (বুখারী)
২৭২. হযরত আবু দারদা (রা) বর্ণনা করেন, আমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছিঃ তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি সর্বহারা ও দুর্বলদের মধ্যে সন্ধান করো; কেননা তাদের অসীলায়ই তোমরা (আল্লাহর) সাহায্য ও রিযিক পেয়ে থাকো। (আবু দাউদ)