যাকাত ফরয হওয়ার তাকিদ ও ফযীলত এবং এই সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়াবলী
আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ
“আর নামায কায়েম কর ও যাকাত আদায় কর।” (সূরা বাকারাঃ ৪৩)
তিনি আরো বলেছেনঃ
“অথচ তাদেরকে কেবল এই হুকুম দেয়া হয়েছিল যে, তারা আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করবে যাতে তা একমুখী হয়ে আল্লাহর জন্য নির্ধারিত হয়ে যায়। আর তারা যেন নিয়মিত নামায পড়ে ও যাকাত আদায় করে। এটিই হচ্ছে সোজা দ্বীন।” (সূরা বাইয়্যিনাহঃ ৫)
তিনি আরো বলেছেনঃ
“তাদের ধন-সম্পদ থেকে সাদকা গ্রহণ কর, যারা সাহায্যে তুমি তাদেরকে গুনাহ মুক্তি করবে এবং তাদেরকে পাক-পবিত্র করে দেবে।” (সূরা তাওবাহঃ ১০৩)
১২০৭. হযরত ইবন উমর (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ পাঁচটি বস্তুর ওপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপন ১. একথার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা) তাঁর বান্দা ও রাসূল। ২. নামায কায়েম করা ৩. যাকাত আদায় করা ৪. বাইতুল্লাহর হজ্জ করা ৫. রমযানের রোযা রাখা। (বুখারী ও মুসলিম)
১২০৮. হযরত তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ জনৈক নজদবাসী রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট এলেন। তাঁর মাথার চুলগুলো ছিল এলোমেলো। তাঁর আওয়াজ আমরা শুনছিলাম কিন্তু তিনি কি বলছিলেন তা বুঝা যাচ্ছিল না। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকটবর্তী ইসলাম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তার জবাবে বললেনঃ সারারাত ও দিনে পাঁচ বার নামায (ফরয)। তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ এগুলো ব্যতীত আরো কোন নামায কি আমার ওপর ফরয আছে? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ না, আর কোন নামায ফরয নেই। তবে তুমি নফল নামায ইচ্ছা করলে পড়তে পার। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ রমযানের রোযাও (ফরয)। লোকটি জিজ্ঞেস করেনঃ এতদ্ব্যতীত আর কোন রোযা কি আমার ওপর ফরয আছে? তিনি বললেনঃ না, আর কোন রোযা ফরয নেই। তবে ইচ্ছে করলে নফল রোযা রাখতে পার। (এরপর) রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে যাকাতের কথা বললেন। লোকটি জিজ্ঞেস করেনঃ এছাড়া আর কোন সাদকা কি আমার ওপর ফরয আছে? জবাব দিলেনঃ না, আর কোন সাদকা ফরয নেই। তবে যদি তুমি চাও নফল সাদকা করতে পার। অতঃপর লোকটি এ কথা বলতে বলতে চলে গেলেন। আল্লাহর কসম, আমি এর ওপর কিছু বাড়াবো না এবং এর থেকে কিছু কমাবোও না। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ যদি এ ব্যক্তি সত্যিকার অর্থে একথা বলে থাকে, তবে সে সফলকাম হয়ে গেছে। (বুখারী ও মুসলিম)
১২০৯. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (সা) মু’আযকে ইয়ামান পাঠান। (পাঠাবার পূর্বে) তাঁকে বলেনঃ তাদেরকে (ইয়ামনবাসীদেরকে) “আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল একথার সাক্ষ্য দেবার দাওয়াত দাও। অতঃপর তারা যদি এ ব্যাপারে তোমার আনুগত্য করে (দাওয়াত গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে যায়), তবে তাদেরকে জানাও আল্লাহ দিন ও রাতে তাদের ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন। এ ব্যাপারেও যদি তারা তোমার আনুগত্য করে, তবে তাদেরকে জানিয়ে দিয়ো যে, আল্লাহ তাদের ওপর যাকাত ফরয করেছেন, যা তাদের ধনীদের থেকে নিয়ে তাদের দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হবে। (বুখারী ও মুসলিম)
১২১০. হযরত ইবনে ওমর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আমাকে লোকদের সাথে যুদ্ধ করার হুকুম দেয়া হয়েছে, যে পর্যন্ত না তারা এ কথার সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর রাসূল। আর যে পর্যন্ত না তারা নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয়। আর যখন তারা এগুলো করবে তখন তাদের রক্ত ও সম্পদকে তারা আমার কাছ থেকে সংরক্ষিত করে নিল এবং তাদের হিসেব নিকেশ হবে আল্লাহর কাছে। (বুখারী ও মুসলিম)
১২১১. হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ইন্তিকালের পর হযরত আবু বকর (রা) তাঁর স্থলে মুসলমানদের খলিফা নিযুক্ত হলেন তখন আরবে যাদের কুফরী করার ছিল তারা কুফরী করলো (এবং আবু বকর (রা) তাদের সাথে লড়াই করার সংকল্প করলেন।) এ সময় হযরত উমর (রা) বললেনঃ আপনি কেমন করে লোকদের সাথে লড়াই করবেন? কারণ রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আমাকে লোকদের সাথে লড়াই করার হুকুম দেয়া হয়েছে, যে পর্যন্ত না তারা ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ -এর স্বীকারোক্তি করে। তারপর যে ব্যক্তি এ স্বীকারোক্তি করে সে তার সম্পদ ও প্রাণ আমার হাত থেকে নিরাপদ করে নেয়, তবে তার হক ব্যতীত, আর তার হিসাব আল্লাহর নিকট। এ কথায় হযরত আবু বকর (রা) বলেনঃ আল্লাহর কসম! যে ব্যক্তি নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে আমি অবশ্যই তার সাথে লড়াই করবো। কারণ যাকাত হচ্ছে সম্পদের হক। আল্লাহর কসম, তারা যদি আমাকে উটের একটি বাচ্চা দিতেও অস্বীকার করে যা তারা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট দিত, তবে আমি তাদের এ অস্বীকৃতির জন্য তাদের সাথে লড়াই করবো। হযরত ওমর (রা) বলেনঃ আল্লাহর কসম, আমি দেখলাম আল্লাহ আবু বকরের হৃদয়কে যুদ্ধের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। এতদ্ব্যতীত এক্ষেত্রে আর কোন কথাই ছিল না। অতএব আমি বুঝতে পারলাম, আবু বকরের কথাই সত্য। (বুখারী ও মুসলিম)
১২১২. হযরত আবু আইউব (রা) থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা) কে বললেনঃ আমাকে এমন আমলের কথা বলুন যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তিনি বললেন, আল্লাহর ইবাদাত কর, তাঁর সাথে আর কোন কিছুকে শরীক করো না, নামায কায়িম কর, যাকাত আদায় কর এবং আত্মীয়দের সাথে সদ্ব্যবহার কর। (বুখারী ও মুসলিম)
১২১৩. হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। একবার জনৈক বেদুঈন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে এসে বললোঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে এমন আমল বলে দেন, যখন আমি তা করব, তখন আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবো। তিনি বললেনঃ আল্লাহর ইবাদাত কর, তাঁর সাথে আর কোন কিছুকে শরীক করো না, নিয়মিত নামায কায়েম কর, ফরয যাকাত আদায় কর এবং রমযানের রোযা রাখ। সে ব্যক্তি বললঃ সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, আমি এর কিছুই বৃদ্ধি করব না। তারপর যখন সে ফিরে যেতে লাগলো, নবী করীম (সা) বললেনঃ যে ব্যক্তি জান্নাতের কোন অধিবাসীকে দেখে আনন্দ করতে চায় সে এ লোকটিকে দেখে। (বুখারী ও মুসলিম)
১২১৪. হযরত জারীর ইবন আবদুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমি নবী করীম (সা)-এর হাতে বাই’য়াত গ্রহণ করলাম, নামায কায়েম করা, যাকাত আদায় করা ও প্রত্যেক মুসলিমের কল্যাণ কামনার ওপর। (বুখারী ও মুসলিম)
১২১৫. হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ যে কোন স্বর্ণ ও রৌপ্যের মালিক যে তার হক (যাকাত) আদায় করে না (তার জেনে রাখা উচিত), কিয়ামতের দিন সে স্বর্ণ ও রৌপ্যকে আগুনে জ্বালিয়ে তা দিয়ে পাত তৈরি করা হবে, তারপর তাকে জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং (কবর থেকে ওঠার সাথে সাথেই) তা দিয়ে ঐ ব্যক্তির পার্শ্বদেশ, কপাল ও পিঠ দাগানো হবে। যখনই ঐ পাতগুলো ঠাণ্ডা হয়ে যাবে সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলোকে আবার জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং তাকে বারবার দাগানো হতে থাকবে সেদিন যার পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। এমন কি অবশেষে লোকদের বিচারপর্ব সম্পন্ন হয়ে যাবে এবং তারা জান্নাতে বা জাহান্নামের পথ দেখতে পাবে (এবং সেদিকে চলতে থাকবে)। বলা হলোঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! তাহলে উটের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত? তিনি বললেন, উটের ব্যাপারেও যদি কোন উটের মালিক উটের হক আদায় না করে (তাহলে তারও সেই দশা)। আর তার হকের মধ্যে (যাকাত ব্যতীত) একটি হক হচ্ছে যেদিন তাদেরকে পানি পান করার জন্য আনা হয় সেদিনকার দুধ (সাদাকা করে দেয়া)। (যদি সে তাদের হক আদায় না করে তাহলে) কিয়ামতের দিন একটি পরিষ্কার ও সমতল ময়দানে তাকে (উটের মালিককে) উটগুলোর পায়ের নিচে উপুড় করে ফেলে দেয়া হবে। ঐ উটগুলো হবে অত্যন্ত শক্তিশালী ও মোটাতাজা। তাদের একটি বাচ্চাও কম হবে না। তারা সবাই নিজেদের পায়ের তলায় তাকে মাড়াবে ও দাঁত দিয়ে কামড়াবে। যখন একটি দল অতিবাহিত হয়ে যাবে তখন আবার আরেক দল মাড়াতে শুরু করবে সে দিন যে দিনটির পরিমাণ হবে, পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। এমনকি অবশেষে লোকদের বিচার পর্ব শেষ যাবে এবং তারা নিজেদের জান্নাত ও জাহান্নামের পথ দেখতে পাবে। বলা হলোঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! গরু অথবা ছাগলের ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত? তিনি বললেনঃ যে গরু ও ছাগলের মালিক তাদের যাকাত আদায় করবে না তাকেও কিয়ামতের দিন একটি পরিষ্কার ও সমতল ময়দানে ঐ গরু ও ছাগলগুলোর পায়ের তলায় উপুড় করে ফেলে দেয়া হবে। সে সময় তাদের সবগুলোই হাজির থাকবে, একটিও হারিয়ে যাবে না। তাদের একটিরও শিং পিছন দিকে মোড়ানো থাকবে না, একটিও শিং বিহীন হবে না এবং একটিরও শিং ভাঙ্গা হবে না। তারা নিজেদের শিং দিয়ে তাদের গুতাতে থাকবে এবং পায়ের খুর দিয়ে মাড়াতে থাকবে। যখন একটি দল অতিবাহিত হয়ে যাবে তখন আবার আরেকটি দল মাড়াতে শুরু করবে। সেদিন যেদিনটির পরিমান হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। এমন কি অবশেষে লোকদের বিচারপর্ব শেষ হয়ে যাবে এবং তারা নিজেদের জান্নাত ও অথবা জাহান্নামের পথ দেখতে পাবে। বলা হলোঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! ঘোড়ার ব্যাপারে কি বলেনঃ তিনি বলেনঃ ঘোড়া তিন প্রকার হবে। কিছু ঘোড়া তো তাদের মালিকের জন্য বোঝায় পরিণত হবে। কিছু ঘোড়া তাদের মালিকের জন্য আবরণ হবে। আর কিছু ঘোড়া হবে তাদের মালিকদের জন্য প্রতিদান। যে সব ঘোড়া তাদের মালিকের জন্য বোঝা ও গুনাহে পরিণত হবে, তা হচ্ছে সেই সব ঘোড়া যাদেরকে তাদের মালিক শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্য, গর্ব করার জন্য, এবং মুসলমানদের কষ্ট দেয়ার জন্য পালন করে। এ ধরণের ঘোড়া তাদের জন্য বোঝা হবে। আর যেসব ঘোড়া তার মালিকের জন্য আবরণ হবে, তা হচ্ছে এমন সব ঘোড়া যেগুলোকে তাদের মালিক পালন করে আল্লাহর হুকুম মুতাবিক, তারপর তাদের পিঠ ও ঘাড়ের ব্যাপারে যে হক নির্ধারণ করেছেন তাও বিস্মৃত হয় না। এ ধরনের ঘোড়া হচ্ছে তার মালিকের জন্য আবরণ। আর যে সব ঘোড়া তাদের মালিকের জন্য প্রতিদান ও সাওয়াবের কারণ হবে তা হচ্ছে যেগুলোকে তাদের মালিক আল্লাহর পথে নিছক মুসলমানদের (জিহাদের) জন্য সবুজ শ্যামল চারণ ক্ষেত্রে অথবা বাগানে ছেড়ে দেয়। প্রতিদিন তারা ঐ চারণ ক্ষেত্রে বা বাগানে যে পরিমাণ ঘাস পাতা খায় তার প্রত্যেকটি ঘাসের পাতার বিনিময়ে আল্লাহর নিকট নেকী লেখা হয়। আর সারাদিন তারা যত পেশাব করে ও মল ত্যাগ করে সে সংখ্যা তাদের জন্য নেকী লেখা হয়। আর তারা পাহাড়ের টিলায় যে লাফালাফি ও ঝাঁপাঝাঁপি করে সারাদিনে যেসব দড়ি ছেঁড়ে তার বিনিময়ে মহান আল্লাহ তাদের প্রতিটি পায়ের দাগ ও পদক্ষেপের সংখ্যা পরিমাণ নেকী লেখেন। আর যখন এ ঘোড়ার মালিক তাদেরকে পানির ঝর্ণার কাছ দিয়ে নিয়ে যায় এবং তারা পানি পান করে, তার বিনিময়েও তাদের মালিকের নামে তার সংখ্যা পরিমাণ নেকী লেখেন। বলা হলোঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ! গাধার ব্যাপারে কি বলেন? জবাব দিলেনঃ গাধার ব্যাপারে আমার কাছে কোন হুকুম আসেনি, তবে এ সম্পর্কে কুরআনের একটি নজির ও ব্যাপক অর্থ ব্যঞ্জক আয়াত আমার কাছে আছে। আয়াতটি হচ্ছেঃ “যে ব্যক্তি অণু পরিমাণ ভালো কাজ করবে সে তার প্রতিফল পাবে।” (সূরা যিলযালঃ ৫)
ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, আর এখানে মুসলিমের মূল পাঠ সন্নিবেশিত হয়েছে।