মুনাফিক ও তাদের হুকুম

১৭৬৫. যায়দ ইবনি আরকাম [রাদি.] থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, আমরা কোন এক সফরে নাবী [সাঃআঃ]-এর সঙ্গে বের হলাম। সফরে এক কঠিন অবস্থা লোকেদেরকে গ্রাস করে নিল। তখন আবদুল্লাহ্ ইবনি উবাই তার সাথী-সঙ্গীদেরকে বলল, “আল্লাহ্‌র রাসূলের সহচরদের জন্য তোমরা ব্যয় করবে না যতক্ষণ তারা সরে পড়ে যারা তার আশে পাশে আছে।” সে এও বলল, “আমরা মাদীনায় প্রত্যাবর্তন করলে তথা হতে প্রবল লোকেরা দুর্বল লোকদের বহিষ্কৃত করবেই।” [এ কথা শুনে] আমি নাবী [সাঃআঃ]-এর কাছে এলাম এবং তাঁকে এ সম্পর্কে জানালাম। তখন তিনি আবদুল্লাহ্ ইবনি উবাইকে ডেকে পাঠালেন। সে অতি জোর দিয়ে কসম খেয়ে বলল, এ কথা সে বলেনি। তখন লোকেরা বলল, যায়দ রাসূল [সাঃআঃ]-এর কাছে মিথ্যা কথা বলেছে। তাদের এ কথায় আমার খুব দুঃখ হল। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্ তাআলা আমার সত্যতার পক্ষে আয়াত অবতীর্ণ করলেনঃ “যখন মুনাফিকরা তোমার কাছে আসে।” এরপর নাবী [সাঃআঃ] তাদেরকে ডাকলেন, যাতে তিনি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন, “কিন্তু তারা তাদের মাথা ফিরিয়ে নিল।” আল্লাহ্‌র বানীঃ “দেয়ালে ঠেস লাগানো কাঠ সদৃশ”-

[সুরাহ মুনাফিকুন ৬৩/৪] [বুখারী পর্ব ৬৫ অধ্যায় ৩ হাদীস নং ৪৯০৩; মুসলিম ৫০ হাঃ ২৭৭২], মুনাফিক -এই হাদীসটির তাহক্কিকঃ সহীহ হাদীস


১৭৬৬. জাবির [রাদি.] থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, আবদুল্লাহ্ ইবনি উবাইকে দাফন করার পর নাবী [সাঃআঃ] তার [ক্ববরের] নিকট এলেন এবং তাকে বের করলেন। অতঃপর তার উপর স্বীয় থুথু প্রক্ষেপ করলেন, আর নিজের জামাটি তাকে পরিয়ে দিলেন।*

[বুখারী পর্ব ২৩ অধ্যায় ২২ হাদীস নং ১২৭০; মুসলিম ৫০ অধ্যায় ১, হাঃ ৬৭৭৩], মুনাফিক -এই হাদীসটির তাহক্কিকঃ সহীহ হাদীস


১৭৬৭. আবদুল্লাহ্ ইবনি উমার [রাদি.] থেকে বর্ণিতঃ

আবদুল্লাহ্ ইবনি উবাই [মুনাফিক সর্দার]-এর মৃত্যু হলে তার পুত্র [যিনি সাহাবী ছিলেন] নাবী [সাঃআঃ]-এর নিকট এসে বললেন, আপনার জামাটি আমাকে দান করুন। আমি সেটা দিয়ে আমার পিতার কাফন পরাতে ইচ্ছে করি। আর আপনি তার জানাযা পড়বেন এবং তার জন্য মাগফিরাত কামনা করবেন। নাবী [সাঃআঃ] নিজের জামাটি তাঁকে দিয়ে দিলেন এবং বললেনঃ আমাকে খবর দিও, আমি তার জানাযা আদায় করব। তিনি তাঁকে খবর দিলেন। যখন নাবী [সাঃআঃ] তার জানাযা আদায়ের ইচ্ছে করলেন, তখন উমার [রাদি.] তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, আল্লাহ্ কি আপনাকে মুনাফিকদের জানাযা আদায় করতে নিষেধ করেননি? তিনি বললেনঃ আমাকে তো দুটির মধ্যে কোন একটি করার ইখতিয়ার দেয়া হয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন ………

اسْتَغْفِرْ لَهُمْ أَوْ لاَ تَسْتَغْفِرْ لَهُمْ إِنْ تَسْتَغْفِرْ لَهُمْ سَبْعِينَ مَرَّة، فَلَنْ يَغْفِرَ اللهُ لَهُمْ

[যার অর্থ] “আপনি তাদের [মুনাফিকদের] জন্য মাগফিরাত কামনা করুন বা মাগফিরাত কামনা না-ই করুন [একই কথা] আপনি যদি সত্তর বারও তাদের জন্য মাগফিরাত কামনা করেন; কখনো আল্লাহ্ তাদের ক্ষমা করবেন না” [সূরাহ আত্ তাওবাহ ৯/৮০]। কাজেই তিনি তার জানাযা পড়লেন, অতঃপর নাযিল হলঃ

وَلاَ تصَلِّ عَلَى أَحَدٍ مِنْهُمْ مَاتَ أَبَدًا

[যার অর্থ] “তাদের কেউ মৃত্যুবরণ করলে আপনি তাদের জানাযা কক্ষণও আদায় করবেন না” [সূরাহ আত্তাওবাহ ৯/৮৪]।

[বুখারী পর্ব ২৩ অধ্যায় ২২ হাদীস নং ১২৬৯; মুসলিম ৫০ হাঃ ২৭৭৪], মুনাফিক -এই হাদীসটির তাহক্কিকঃ সহীহ হাদীস


১৭৬৮. আবদুল্লাহ্ [রাদি.] থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, কাবার কাছে দুজন কুরাইশী এবং একজন সাকাফী অথবা দুজন সাকাফী ও একজন কুরাইশী একত্রিত হয়। তাদের পেটের মেদ ছিল অধিক; কিন্তু অন্তরে বুদ্ধি ছিল কম। তাদের একজন বলল, তোমাদের কি ধারণা, আমরা যা বলছি তা কি আল্লাহ্ শুনছেন? উত্তরে অপর এক ব্যক্তি বলল, আমরা যদি জোরে বলি, তাহলে তিনি শুনতে পান। আর যদি চুপে চুপে বলি, তাহলে তিনি শুনতে পান না। তৃতীয় ব্যক্তি বলল, আমরা জোরে বললে যদি তিনি শুনতে পান, তাহলে চুপে চুপে বললেও তিনি শুনতে পাবেন। তখন আল্লাহ্ অবতীর্ণ করলেন,

وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَتِرُونَ أَنْ يَشْهَدَ عَلَيْكُمْ سَمْعُكُمْ وَلاَ أَبْصَارُكُمْ وَلاَ جُلُودُكُمْ

তোমাদের চোখ, কান এবং তোমাদের চামড়া তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে, এ থেকে তোমরা কখনো নিজেদের লুকাতে পারবে না….. [ হা মীম সিজদাহঃ ২২; আয়াতের শেষ পর্যন্ত]।

[বুখারী পর্ব ৬৫, অধ্যায় ২, হাদীস নং ৪৮১৭;], মুনাফিক -এই হাদীসটির তাহক্কিকঃ সহীহ হাদীস


১৭৬৯. যায়দ ইবনি সাবিত [রাদি.] থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, নাবী [সাঃআঃ]-এর সঙ্গে উহুদ যুদ্ধে যাত্রা করে তাঁর কতিপয় সাথী ফিরে আসলে একদল লোক বলতে লাগল, আমরা তাদেরকে হত্যা করব, আর অন্য দলটি বলতে লাগলো, না, আমরা তাদেরকে হত্যা করব না। এ সময়ই

فَمَا لَكُمْ فِي الْمُنَافِقِينَ فِئَتَيْنِ

[তোমাদের হল কী, তোমরা মুনাফিকদের ব্যাপারে দুদল হয়ে গেলে?] [সূরাহ আন-নিসা ৪/৮৮] আয়াতটি নাযিল হয়।

[বুখারী পর্ব ২৯, অধ্যায় ১০, হাদীস নং ১৮৮৪; মুসলিম অধ্যায় ৫০, হাঃ ২৭৭৬], মুনাফিক -এই হাদীসটির তাহক্কিকঃ সহীহ হাদীস


১৭৭০. আবু সাঈদ খুদরী [রাদি.] থেকে বর্ণিতঃ

রাসূলুল্লাহ [সাঃআঃ]-এর যুগে তিনি যখন যুদ্ধে বের হতেন তখন কিছু সংখ্য মুনাফিক ঘরে বসে থাকত এবং রাসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] বেরিয়ে যাওয়ার পর বসে থাকতে পারায় আনন্দ প্রকাশ করত। এরপর রাসূলুল্লাহ [সাঃআঃ] ফিরে আসলে তাঁর কাছে শপথ করে ওজর পেশ করত এবং যে কাজ করেনি সে কাজের জন্য প্রশংসিত হতে পছন্দ করত। তখন এ আয়াত অবতীর্ণ হল ………

لاَ يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَفْرَحُونَ

“তুমি কখনও মনে কর না যে, যারা নিজেদের কৃতকর্মের জন্য আনন্দিত হয় এবং নিজেরা যা করেনি তার জন্য প্রশংসিত হতে ভালবাসে” [সূরাহ আল ইমরান ৩/১৮৮]।

[বুখারী পর্ব ৬৫, অধ্যায় ১৬, হাদীস নং ৪৫৬৭; মুসলিম ৫০, হাঃ ২৭৭৭], মুনাফিক -এই হাদীসটির তাহক্কিকঃ সহীহ হাদীস


১৭৭১. আলক্বামাহ ইবনু ওয়াক্কাস থেকে বর্ণিতঃ

মারওয়ান [রহ.] তাঁর দারোয়ানকে বললেন, হে নাফি! তুমি ইবনু আব্বাস [রাদি.]-এর কাছে গিয়ে বল, যদি প্রাপ্ত বস্তুতে আনন্দিত এবং করেনি এমন কাজ সম্পর্কে প্রশংসিত হতে আশাবাদী প্রত্যেক ব্যক্তিরই শাস্তি প্রাপ্য হয় তাহলে সকল মানুষই শাস্তিপ্রাপ্ত হবে। ইবনু আব্বাস [রাদি.] বললেন, এটা তোমাদের মাথা ঘামানোর বিষয় নয়। একদা নাবী [সাঃআঃ] ইয়াহূদীদেরকে ডেকে একটা বিষয় জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাতে তারা সত্য গোপন করে বিপরীত তথ্য দিয়েছিল। এতদসত্ত্বেও তারা তাদের দেয়া উত্তরের বিনিময়ে প্রশংসা অর্জনের আশা করেছিল এবং তাদের সত্য গোপনের জন্যে আনন্দিত হয়েছিল। তারপর ইবনু আব্বাস [রাদি.] পাঠ করলেন- arbi ………… “স্মরণ কর, যখন আল্লাহ্ প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন আহলে কিতাবের, তোমরা মানুষের কাছে কিতাব স্পষ্টভাবে প্রকাশ করবে এবং তা গোপন করবে না। কিন্তু তারা সে প্রতিশ্রুতি নিজেদের পেছনে ফেলে রাখল এবং তার পরিবর্তে নগণ্য বিনিময় গ্রহণ করল। সুতরাং তারা যা বিনিময় গ্রহণ করল কত নিকৃষ্ট তা! তুমি কখনও মনে কর না যে, যারা নিজেদের কৃতকর্মের জন্য আনন্দিত হয় এবং নিজেরা যা করেনি তার জন্য প্রশংসিত হতে ভালবাসে, তারা আযাব থেকে পরিত্রাণ পাবে। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি” [সূরাহ আল ইমরান ৩/১৮৭-১৮৮]।

[বুখারী পর্ব ৬৫ অধ্যায় ১৬ হাদীস নং ৪৫৬৮; মুসলিম ৫০ হাদীস নং ২৭৭৮], মুনাফিক এই হাদীসটির তাহক্কিকঃ সহীহ হাদীস


১৭৭২. আনাস [রাদি.] থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, এক খ্রিস্টান ব্যক্তি মুসলিম হল এবং সূরা বাকারাহ ও সূরা আল-ইমরান শিখে নিল। নাবী [সাঃআঃ]-এর জন্য সে অহী লিখত। অতঃপর সে আবার খ্রিস্টান হয়ে গেল। সে বলতে লাগল, আমি মুহাম্মাদ [সাঃআঃ]-কে যা লিখে দিতাম তার চেয়ে বেশি কিছু তিনি জানেন না। [নাউজুবিল্লাহ] কিছুদিন পর আল্লাহ্ তাকে মৃত্যু দিলেন। খ্রিস্টানরা তাকে দাফন করল। কিন্তু পরদিন সকালে দেখা গেল, কবরের মাটি তাকে বাইরে নিক্ষেপ করে দিয়েছে। এটা দেখে খ্রিস্টানরা বলতে লাগল- এটা মুহাম্মাদ [সাঃআঃ] এবং তাঁর সাহাবীদেরই কাজ। যেহেতু আমাদের এ সাথী তাদের হতে পালিয়ে এসেছিল। এ জন্যই তারা আমাদের সাথীকে কবর হতে উঠিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছে। তাই যতদূর পারা যায় গভীর করে কবর খুঁড়ে তাকে আবার দাফন করল। কিন্তু পরদিন সকালে দেখা গেল, কবরের মাটি তাকে আবার বাইরে ফেলে দিয়েছে। এবারও তারা বলল, এটা মুহাম্মাদ [সাঃআঃ] ও তাঁর সাহাবীদের কাণ্ড। তাদের নিকট হতে পালিয়ে আসার কারণে তারা আমাদের সাথীকে কবর হতে উঠিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছে। এবার আরো গভীর করে কবর খনন করে দাফন করল। পরদিন ভোরে দেখা গেল কবরের মাটি এবারও তাকে বাইরে নিক্ষেপ করেছে। তখন তারাও বুঝল, এটা মানুষের কাজ নয়। কাজেই তারা লাশটি ফেলে রাখল।

[বুখারী পর্ব ৬১ অধ্যায় ২৫ হাদীস নং ৩৬১৭; মুসলিম ৫০ হাঃ ২৭৮১], মুনাফিক -এই হাদীসটির তাহক্কিকঃ সহীহ হাদীস

Was this article helpful?

Related Articles