ঈলা ও স্ত্রী সংসৰ্গ হতে দূরে থাকা এবং তাদেরকে ইখতিয়ার দেয়া এবং আল্লাহ তা’আলার বাণীঃ “যদি তার বিরুদ্ধে তোমরা একে অপরকে সাহায্য কর।” (সুরাহ আল বাক্বারাহ ২/২২৬)

৯৪৪. আবদুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, উমর ইবনু খাত্তাব (রাঃ)-কে এ আয়াতের ব্যাখ্যা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার জন্য আমি এক বছর অপেক্ষা করেছি। কিন্তু তাঁর ব্যক্তি প্রভাবের ভয়ে আমি তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে সক্ষম হইনি। অবশেষে তিনি হজ্জের উদ্দেশে রওয়ানা হলে, আমিও তাঁর সঙ্গে গেলাম। প্রত্যাবর্তনের সময় আমরা যখন কোন একটি রাস্তা অতিক্রম করছিলাম, তখন তিনি প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের জন্য একটি পিলু গাছের আড়ালে গেলেন। ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) বলেন, তিনি প্রয়োজন সেরে না আসা পর্যন্ত আমি সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলাম। এরপর তাঁর সঙ্গে পথ চলতে চলতে বললাম, হে আমীরুল মুমিনীন! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রীদের কোন্ দু’জন তার বিপক্ষে একমত হয়ে পরস্পর একে অন্যকে সহযোগিতা করেছিলেন? তিনি বললেন, তাঁরা দু’জন হল হাফসাহ ও ’আয়িশাহ (রাঃ)।

ইবনু আব্বাস বলেন, আমি বললাম, আল্লাহর শপথ! আমি আপনাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করার জন্য এক বছর যাবত ইচ্ছে করেছিলাম। কিন্তু আপনার ভয়ে আমার পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। তখন ’উমার (রাঃ) বললেন, অমন করবে না। যে বিষয়ে তুমি মনে করবে যে, আমি তা জানি, তা আমাকে জিজ্ঞেস করবে। এ বিষয়ে আমার জানা থাকলে আমি তোমাকে জানিয়ে দেব। তিনি বলেন, এরপর ’উমার (রাঃ) বললেন, আল্লাহর শপথ! জাহিলী যুগে মহিলাদের কোন অধিকার আছে বলে আমরা মনে করতাম না। অবশেষে আল্লাহ্ তা’আলা তাদের সম্পর্কে যে বিধান নাযিল করার ছিল তা নাযিল করলেন এবং তাদের হক হিসাবে যা নির্দিষ্ট করার ছিল তা নির্দিষ্ট করলেন।

তিনি বলেন, একদা আমি কোন এক বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করছিলাম, এমতাবস্থায় আমার স্ত্রী আমাকে বললেন, কাজটি যদি তুমি এভাবে এভাবে কর (তাহলে ভাল হবে)। আমি বললাম, তোমার কী প্রয়োজন? এবং আমার কাজে তোমার এ অনধিকার চর্চা কেন। সে আমাকে বলল, হে খাত্তাবের বেটা! কী আশ্চর্য, তুমি চাও না যে, আমি তোমার কথার উত্তর দান করি অথচ তোমার কন্যা হাফসা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথার পিঠে কথা বলে থাকে। এমনকি একদিন তো সে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে রাগান্বিত করে ফেলে।

এ কথা শুনে ’উমার (রাঃ) দাঁড়িয়ে গেলেন এবং চাদরখানা নিয়ে তার বাড়িতে চলে গেলেন। তিনি তাকে বললেন, বেটী! তুমি নাকি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথার প্রতি-উত্তর করে থাক। ফলে তিনি দিনভর মনঃক্ষুন্ন থাকেন। হাফসাহ (রাঃ) বলেন, আল্লাহর কসম! আমরা তো অবশ্যই তাঁর কথার জবাব দিয়ে থাকি। ’উমার (রাঃ) বলেন, আমি বললাম, জেনে রাখ! আমি তোমাকে আল্লাহর শাস্তি এবং রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অসন্তুষ্টি সম্পর্কে সতর্ক করছি। রূপ-সৌন্দর্যের কারণে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভালবাসা যাকে গৰ্বিতা করে রেখেছে, সে যেন তোমাকে প্রতারিত না করতে পারে। এ কথা বলে ’উমার মত ’আয়িশাহ (রাঃ)-কে বোঝাচ্ছিলেন।

উমার (রাঃ) বলেন, এরপর আমি সেখান থেকে বেরিয়ে আসলাম এবং উম্মু সালামাহ (রাঃ)-এর ঘরে প্রবেশ করলাম ও এ বিষয়ে তার সাথে কথাবার্তা বললাম। কারণ, তার সাথে আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। তখন উম্মু সালামাহ (রাঃ) বললেন, হে খাত্তাবের বেটা! কী আশ্চর্য, তুমি প্রত্যেক ব্যাপারেই হস্তক্ষেপ করছ, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার স্ত্রীদের ব্যাপারেও হস্তক্ষেপ করতে চাচ্ছ। আল্লাহর কসম! তিনি আমাকে এমন কঠোরভাবে ধরলেন যে, আমার গোস্বাকে একেবারে শেষ করে দিলেন। এরপর আমি তার কাছ থেকে চলে আসলাম।

আমার একজন আনসার বন্ধু ছিল। যদি আমি কোন মজলিশ থেকে অনুপস্থিত থাকতাম তাহলে সে এসে মজলিশের খবর আমাকে জানাত। আর সে যদি অনুপস্থিত থাকত তাহলে আমি এসে তাকে মজলিশের খবর জানাতাম। সে সময় আমরা গাস্‌সানী বাদশাহর আক্রমণের আশংকা করছিলাম। আমাদেরকে বলা হয়েছিল যে, সে আমাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য যাত্রা করেছে। তাই আমাদের হৃদয়-মন এ ভয়ে শংকিত ছিল।

এমন সময় আমার আনসার বন্ধু এসে দরজায় করাঘাত করে বললেন, দরজা খুলুন, দরজা খুলুন। আমি বললাম, গাস্‌সানীরা এসে পড়েছে নাকি? তিনি বললেন, বরং এর চেয়েও সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সহধর্মিণীদের থেকে পৃথক হয়ে গেছেন। তখন আমি বললাম, হাফসাহ ও ’আয়িশাহর নাক ধূলায় ধূসরিত হোক। এরপর আমি কাপড় নিয়ে বেরিয়ে চলে আসলাম। গিয়ে দেখলাম, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি উঁচু টঙে অবস্থান করছেন। সিঁড়ি বেয়ে সেখানে পৌছতে হয়। সিঁড়ির মুখে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একজন কালো গোলাম বসা ছিল।

আমি বললাম, বলুন, ’উমার ইবনু খাত্তাব এসেছেন। এরপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে অনুমতি দিলেন, আমি তাঁকে এসব ঘটনা বললাম, এক পর্যায়ে আমি যখন উম্মু সালামার কপোপকথন পর্যন্ত পৌছলাম তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হাসলেন। এ সময় তিনি একটা চাটাইয়ের উপর শুয়ে ছিলেন। চাটাই এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাঝে আর কিছুই ছিল না। তার মাথার নিচে ছিল খেজুরের ছালভর্তি চামড়ার একটি বালিশ এবং পায়ের কাছে ছিল সল্‌ম বৃক্ষের পাতার একটি স্থূপ ও মাথার উপর লটকানো ছিল চামড়ার একটি মশক। আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একপার্শ্বে চাটাইয়ের দাগ দেখে কেঁদে ফেললে তিনি বললেন, তুমি কেন কাঁদছ? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! কিসরা ও কায়সার পার্থিব ভােগবিলাসের মধ্যে ডুবে আছে, অথচ আপনি আল্লাহর রাসূল। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি পছন্দ করো না যে, তারা দুনিয়া লাভ করুক, আর আমরা আখিরাত লাভ করি।

সহীহুল বুখারী, পৰ্ব ৬৫; তাফসীর, অধ্যায় ৬৬, হাঃ ৪৯১৩; মুসলিম, পর্ব ১৮ ; ত্বলাক, অধ্যায় ৫, হাঃ ১৪৭৯


৯৪৫. আবদুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বহুদিন ধরে উৎসুক ছিলাম যে, আমি উমার ইবনু খাত্তাব (রাঃ)-এর নিকট জিজ্ঞেস করব, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিবিগণের মধ্যে কোন্ দু’জন সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেছেনঃ “তোমরা দু’জন যদি আল্লাহর নিকট তওবা কর (তবে এটা উত্তম)। কেননা, তোমাদের মন সঠিক পথ থেকে সরে গেছে।” এরপর একবার তিনি [উমার (রাঃ)] হাজ্জের জন্য রওয়ানা হলেন এবং আমিও তাঁর সঙ্গে হজ্জে গেলাম। (ফিরে আসার পথে) তিনি ইতিনজার জন্য রাস্তা থেকে সরে গেলেন। আমি পানি পূর্ণ পাত্র হাতে তাঁর সাথে গেলাম। তিনি ইতিনজা করে ফিরে এলে আমি ওযূর পানি তাঁর হাতে ঢেলে দিতে লাগলাম।

তিনি যখন ওযূ করছিলেন, তখন আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, হে আমীরুল মু’মিনী! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহধর্মিণীগণের মধ্যে কোন্ দু’জন, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ্ তাআলা বলেছেনঃ “তোমরা দু’জন যদি আল্লাহর কাছে তওবা কর (তবে আমাদের জন্য উত্তম), কেননা, তোমাদের মন সঠিক পথ থেকে সরে গেছে।” জবাবে তিনি বললেন, হে ইবনু ’আব্বাস! আমি তোমার প্রশ্ন শুনে অবাক হচ্ছি। তারা দুজন তো আয়িশাহ (রাঃ) ও হাফসাহ (রাঃ)।

এরপর ’উমার (রাঃ) ঘটনাটি বর্ণনা করলেন, “আমি এবং আমার একজন আনসারী প্রতিবেশী যিনি উমাইয়াহ ইবনু যায়দ গোত্রের লোক এবং তারা মদীনাহর উপকণ্ঠে বসবাস করত। আমরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে পালাক্রমে সাক্ষাত করতাম। সে একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে যেত, আমি আর একদিন যেতাম। যখন আমি দরবারে যেতাম, ঐ দিন দরবারে ওয়াহী অবতীর্ণসহ যা ঘটত সবকিছুর খবর আমি তাকে দিতাম এবং সেও অনুরূপ খবর আমাকে দিত। আমরা কুরাইশরা নিজেদের স্ত্রীগণের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছিলাম।

কিন্তু আমরা যখন আনসারদের মধ্যে এলাম, তখন দেখতে পেলাম, তাদের স্ত্রীগণ তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে আছে এবং তাদের ওপর কর্তৃত্ব করে চলেছে। সুতরাং আমাদের স্ত্রীরাও তাদের দেখাদেখি সেরূপ ব্যবহার করতে লাগল। একদিন আমি আমার স্ত্রীর প্রতি নারাজ হলাম এবং তাকে উচ্চস্বরে কিছু বললাম, সেও প্রতি-উত্তর দিল। আমার কাছে এ রকম প্ৰতি-উত্তর দেয়াটা অপছন্দ হল। সে বলল, আমি আপনার কথার পাল্টা উত্তর দিচ্ছি এতে অবাক হচ্ছেন কেন? আল্লাহর কসম, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিবিগণ তাঁর কথার মুখে মুখে পাল্টা উত্তর দিয়ে থাকেন এবং তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার একদিন এক রাত পর্যন্ত কথা না বলে কাটান।

(উমার (রাঃ) বলেন), এ কথা শুনে আমি ঘাবড়ে গেলাম এবং আমি বললাম, তাদের মধ্যে যারা এরূপ করেছে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরপর আমি আমার কাপড় পরিধান করলাম এবং আমার কন্যা হাফসার ঘরে প্রবেশ করলাম এবং বললামঃ হাফসা! তোমাদের মধ্য থেকে কারো প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি সারা দিন রাত পর্যন্ত অসন্তুষ্ট থাকেননি? সে উত্তর করল, হ্যাঁ। আমি বললাম, তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছ। তোমরা কি এ ব্যাপারে ভীত হচ্ছাে না যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অসন্তুষ্টির কারণে আল্লাহ্ অসন্তুষ্ট হয়ে যাবেন? পরিণামে তোমরা ধ্বংসের মধ্যে পড়ে যাবে। সুতরাং তুমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে অতিরিক্ত কোন জিনিস দাবি করবে না এবং তাঁর কথার প্রতি-উত্তর করবে না এবং তার সাথে কথা বলা বন্ধ করবে না। তোমার যদি কোন কিছুর প্রয়োজন হয়, তবে আমার কাছে চেয়ে নেবে। আর তোমার সতীন তোমার চেয়ে অধিক রূপবতী এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অধিক প্রিয় তা যেন তোমাকে বিভ্রান্ত না করে। এখানে সতীন বলতে আয়িশাহ (রাঃ)-কে বোঝানো হয়েছে।

উমার (রাঃ) আরো বলেন, এ সময় আমাদের মধ্যে এ কথা ছড়িয়ে পড়েছিল যে, গাস্‌সানের শাসনকর্তা আমাদের ওপর আক্রমণ চালাবার উদ্দেশে তাদের ঘােড়াগুলোক প্রস্তুত করছে। আমার প্রতিবেশী আনসার তার পালার দিন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেদমত থেকে রাতে ফিরে এসে আমার দরজায় খুব জোরে করাঘাত করল এবং জিজ্ঞেস করল, আমি ঘরে আছি কিনা? আমি শংকিত অবস্থায় বেরিয়ে এলাম। সে বলল, আজ এক বিরাট ঘটনা ঘটে গেছে। আমি বললাম, সেটা কী? গাস্‌সানিরা কি এসে গেছে? সে বলল, না তার চেয়েও বড় ঘটনা এবং তা ভয়ংকর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সহধর্মিণীগণকে ত্বলাক (তালাক) দিয়েছেন। আমি বললাম, হাফসা তো ধ্বংস হয়ে গেল, ব্যর্থ হলো। আমি আগেই ধারণা করেছিলাম, খুব শীগগীরই এরকম একটা কিছু ঘটবে।

এরপর আমি পোশাক পরিধান করলাম এবং ফজরের সালাত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে আদায় করলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওপরের কামরায় (মাশরুবা) একাকী আরোহণ করলেন, আমি তখন হাফসার কাছে গেলাম এবং তাকে কাঁদতে দেখলাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কাঁদছ কেন? আমি কি তোমাকে এ ব্যাপারে পূর্বেই সতর্ক করে দেইনি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি তোমাদের সকলকে ত্বলাক (তালাক) দিয়েছেন? সে বলল, আমি জানি না। তিনি ওখানে ওপরের কামরায় একাকী রয়েছেন।

আমি সেখান থেকে বেরিয়ে এসে মিম্বরের কাছে বসলাম। সেখানে কিছু সংখ্যক লোক বসা ছিল এবং তাদের মধ্যে অনেকেই কাঁদছিল। আমি তাদের কাছে কিছুক্ষণ বসলাম, কিন্তু আমি এ অবস্থা সহ্য করতে পারছিলাম না। সুতরাং যে ওপরের কামরায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবস্থান করছিলেন আমি সেই ওপরের কামরায় গেলাম এবং তাঁর হাবশী কালো খাদিমকে বললাম, তুমি কি উমারের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে যাবার অনুমতি এনে দেবে? খাদিমটি গেল এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে কথা বলল। ফিরে এসে উত্তর করল, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আপনার কথা বলেছি; কিন্তু তিনি নিরুত্তর আছেন। তখন আমি ফিরে এলাম এবং যেখানে লোকজন বসা ছিল সেখানে বসলাম। কিন্তু এ অবস্থা আমার কাছে অসহ্য লাগছিল। তাই আবার এসে খাদেমকে বললাম! তুমি কি উমরের জন্য অনুমতি এনে দিবে? সে প্রবেশ করল এবং ফিরে এসে বলল, আপনার কথা বলেছি কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুপ থেকেছেন। তাই আমি আবার ফিরে এসে মিম্বরের কাছে ঐ লোকজনের সাথে বসলাম।

কিন্তু এ অবস্থা আমার কাছে অসহ্য লাগছিল। পুনরায় আমি খাদেমের কাছে গেলাম এবং বললাম, তুমি কি উমারের জন্য অনুমতি এনে দেবে? সে গেল এবং আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে বলতে লাগল, আমি আপনার কথা উল্লেখ করলাম; কিন্তু তিনি নিরুত্তর আছেন। যখন আমি ফিরে যাবার উদ্যোগ নিয়েছি, এমন সময় খাদিমটি আমাকে ডেকে বলল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাকে অনুমতি দিয়েছেন। এরপর আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট প্রবেশ করে দেখলাম, তিনি খেজুরের চাটাইর ওপর চাদরবিহীন অবস্থায় খেজুরের পাতা ভর্তি একটি বালিশে ভর দিয়ে শুয়ে আছেন। তাঁর শরীরে পরিষ্কার চাটাইয়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। আমি তাঁকে সালাম করলাম এবং দাঁড়ানো অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আপনার বিবিগণকে ত্বলাক (তালাক) দিয়েছেন? তিনি আমার দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, না (অর্থাৎ ত্বলাক (তালাক) দেইনি)। আমি বললাম, আল্লাহু আকবার।

এরপর আলাপটা নমনীয় করার উদ্দেশে দাঁড়িয়ে থেকেই বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি যদি শোনেন তাহলে বলিঃ আমরা কুরাইশগণ, মহিলাদের ওপর আমাদের প্রতিপত্তি খাটাম; কিন্তু আমরা মদীনায় এসে দেখলাম, এখানকার পুরুষদের ওপর নারীদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিদ্যমান। এ কথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হাসলেন। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! যদি আপনি আমার কথার দিকে একটু নজর দেন। আমি হাফসার কাছে গেলাম এবং আমি তাকে বললাম, তোমার সতীনের রূপবতী হওয়া ও রাসসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রিয় পাত্রী হওয়া তোমাকে যেন ধোকায় না ফেলে। এর দ্বারা ’আয়িশাহ (রাঃ)-এর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় মুচকি হাসলেন।

আমি তাঁকে হাসতে দেখে বসে পড়লাম। এরপর আমি তার ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, আল্লাহর কসম, শুধুমাত্র তিনটি চামড়া ব্যতীত আর আমি তাঁর ঘরে উল্লেখযোগ্য কিছুই দেখতে পেলাম না। অতঃপর আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! দোয়া করুন, আল্লাহ্ তা’আলা যাতে আপনার উম্মতদের সচ্ছলতা দান করেন। কেননা, পারস্য ও রোমানদের প্রাচুর্য দান করা হয়েছে এবং তাদের দুনিয়ার আরাম প্রচুর পরিমাণে দান করা হয়েছে; অথচ তারা আল্লাহর ইবাদাত করে না। এ কথা শুনে হেলান দেয়া অবস্থা থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোজা হয়ে বসে বললেন, হে খাত্তাবের পুত্র! তুমি কি এখনো এ ধারণা পোষণ করছ? ওরা ঐ লোক, যারা উত্তম কাজের প্রতিদান এ দুনিয়ায় পাচ্ছে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমার ক্ষমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। হাফসাহ (রাঃ) কর্তৃক ’আয়িশাহ (রাঃ)-কে কথা ফাঁস করে দেয়ার কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঊনত্রিশ দিন তার বিবিগণ থেকে আলাদা থাকেন।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, আমি এক মাসের মধ্যে তাদের কাছে যাব না তাদের প্রতি গোস্বার কারণে। তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাঁকে মৃদু ভর্ৎসনা করেন। সুতরাং যখন ঊনত্রিশ দিন হয়ে গেল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম ’আয়িশাহ (রাঃ)-এর কাছে গেলেন এবং তাকে দিয়েই শুরু করলেন। ’আয়িশাহ (রাঃ) তাঁকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কমস করেছেন যে, একমাসের মধ্যে আমাদের কাছে আসবেন না; কিন্তু এখন তো উনত্রিশ দিনেই এসে গেলেন। আমি প্রতিটি দিন এক এক করে হিসাব করে রেখেছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ঊনত্রিশ দিনেও একমাস হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এ মাস ২৯ দিনের ’আয়িশাহ (রাঃ) আরও বলেন, ঐ সময় আল্লাহ্ তাআলা ইখতিয়ারের (সূরাহ আহবের ২৮নং) আয়াত নাযিল করেন এবং তিনি তাঁর বিবিগণের মধ্যে আমাকে দিয়েই শুরু করেন এবং আমি তাঁকেই গ্রহণ করি।এরপর তিনি অন্য বিবিগণের অভিমত চাইলেন। সকলেই তাই বলল, যা আয়িশাহ (রাঃ) বলেছিলেন।

সহীহুল বুখারী, পর্ব ৬৭ : বিবাহ, অধ্যায় ৮৩, হাঃ ৫১৯১; মুসলিম, পর্ব ১৮ : ত্বলাক, অধ্যায় ৫, হাঃ ১৪৭৯

Was this article helpful?

Related Articles