ইসলামের দাওয়াত দিয়ে হিরাক্লিয়াসের নিকট নাবী (সাঃ)-এর পত্র।

১১৬২. ইবনি আব্বাস [রাদি.] হইতে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, আবু সুফ্ইয়ান [রাদি.] আমাকে সামনাসামনি হাদীস শুনিয়েছেন। আবু সুফ্ইয়ান [রাদি.] বলেন, আমাদের আর রাসূলুল্লাহ [সাঃআঃ]-এর মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির মেয়াদকালে আমি ভ্রমণে বের হয়েছিলাম। আমি তখন সিরিয়ায় অবস্থান করছিলাম। তখন নাবী [সাঃআঃ]-এর পক্ষ থেকে হিরাক্লিয়াসের নিকট একখানা পত্র পৌঁছান হল। দাহ্ইয়াতুল কালবী এ চিঠিটা বুসরার শাসককে দিয়েছিলেন। এরপর তিনি হিরাক্লিয়াসের নিকট পৌঁছিয়ে দিলেন। পত্র পেয়ে হিরাক্লিয়াস বলিলেন, নাবী [সাঃআঃ]র দাবীদার ব্যক্তির গোত্রের কেউ এখানে আছে কি? তারা বলিল, হ্যাঁ আছে। কয়েকজন কুরাইশীসহ আমাকে ডাকা হলে আমরা হিরাক্লিয়াসের নিকট গেলাম এবং আমাদেরকে তাহাঁর সম্মুখে বসানো হল। এরপর তিনি বলিলেন, নাবী [সাঃআঃ]র দাবীদার ব্যক্তির তোমাদের মধ্যে নিকটতম আত্মীয় কে? আবু সুফ্ইয়ান বলেন, উত্তরে বললাম, আমিই। তারা আমাকে তার সম্মুখে এবং আমার সাথীদেরকে আমার পেছনে বসালেন। তারপর দোভাষীকে ডাকলেন এবং বলিলেন, এদেরকে জানিয়ে দাও যে, আমি নাবী [সাঃআঃ]র দাবীদার ব্যক্তিটি সম্পর্কে [আবু সুফ্ইয়ানকে] কিছু জিজ্ঞেস করলে সে যদি আমার নিকট মিথ্যা বলে তোমরা তার মিথ্যা বলা সম্পর্কে ধরবে। আবু সুফ্ইয়ান বলেন, যদি তাহাদের পক্ষ থেকে আমাকে মিথ্যুক প্রমাণের আশঙ্কা না থাকত তাহলে আমি আমি মিথ্যা বলতামই। এরপর দোভাষীকে বলিলেন, একে জিজ্ঞেস কর যে, তোমাদের মধ্যে এ ব্যক্তির বংশ মর্যাদা কেমন? আবু সুফ্ইয়ান বলিলেন, তিনি আমাদের মধ্যে অভিজাত বংশের অধিকারী। তিনি জিজ্ঞেস করিলেন যে, তাহাঁর পূর্বপুরুষদের কেউ কি রাজা-বাদশাহ ছিলেন? আমি বললাম, না। তিনি জিজ্ঞেস করিলেন, তাহাঁর বর্তমানের কথাবার্তার পূর্বে তোমরা তাঁকে কখনো মিথ্যাচারের অপবাদ দিয়েছ কি? আমি বললাম, না। তিনি বলিলেন, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা তাহাঁর অনুসরণ করছে, না দুর্বলগণ? আমি বললাম, বরং দুর্বলগণ। তিনি বলিলেন, তাহাদের সংখ্যা বাড়ছে না কমছে। আমি বললাম, বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বলিলেন, তাহাঁর ধর্মে প্রবিষ্ট হওয়ার পর তাহাঁর প্রতি বিতৃষ্ণাবশতঃ কেউ কি ধর্ম ত্যাগ করে? আমি বললাম, না। তিনি বলিলেন, তোমরা তাহাঁর বিরুদ্ধে কোন যুদ্ধ করেছ কি? বললাম, জ্বী হ্যাঁ। তিনি বলিলেন, তাহাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধের ফলাফল কী হয়েছে? আমি বললাম, আমাদের ও তাহাদের মধ্যে যুদ্ধের ফলাফল হলঃ একবার তিনি জয়ী হন, আর একবার আমরা জয়ী হই। তিনি বলিলেন, তিনি প্রতিশ্রতি ভঙ্গ করেননি? বললাম, না। তবে বর্তমানে আমরা একটি সন্ধির মেয়াদে আছি। দেখি এতে তিনি কী করেন। আবু সুফ্ইয়ান বলেন, আল্লাহ্‌র শপথ! এটি ব্যতীত অন্য কোন কথা ঢুকিয়ে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। বলিলেন, তাহাঁর পূর্বে এমন কথা কেউ বলেছে কি? বললাম, না। তারপর তিনি তাহাঁর দোভাষীকে বলিলেন যে, একে জানিয়ে দাও যে, আমি তোমাকে তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তির বংশমর্যাদা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তারপর তুমি বলেছ যে, সে আমাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত। তদ্রুপ রসূল [সাঃআঃ]গণ শ্রেষ্ঠ বংশেই জন্মলাভ করে থাকেন। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, তাহাঁর পূর্বপুরুষের কেউ রাজা-বাদশাহ ছিলেন কিনা? তুমি বলেছ না। তাই আমি বলছি যে, যদি তাহাঁর পূর্বপুরুষদের কেউ রাজা-বাদশাহ থাকতেন তাহলে বলতাম, তিনি তাহাঁর পূর্বপুরুষদের রাজত্ব ফিরে পেতে চাচ্ছেন। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, দুর্বলগণ তাহাঁর অনুসারী, না সম্ভ্রান্তগণ? তুমি বলেছ, দুর্বলগণই। আমি বলছি যে, যুগে যুগে দুর্বলগণই রসূল [সাঃআঃ]দের অনুসারী হয়ে থাকে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, এ দাবীর পূর্বে তোমরা কখনও তাঁকে মিথ্যাবাদিতার অপবাদ দিয়েছিলে কি? তুমি উত্তরে বলেছ যে, না। তাতে আমি বুঝেছি যে, যে ব্যক্তি প্রথমে মানুষদের সঙ্গে মিথ্যাচার ত্যাগ করেন, তারপর আল্লাহ্‌র সঙ্গে মিথ্যাচারিতা করবেন, তা হইতে পারে না। আমি তোমাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, তাহাঁর ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর তাহাঁর প্রতি বিরক্ত হয়ে কেউ ধর্ম ত্যাগ করে কিনা? তুমি বলেছ, ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি বলছি, ঈমান এভাবেই পূর্ণতা লাভ করে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, তোমরা তাহাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছ কি? তুমি বলেছ যে, যুদ্ধ করেছ এবং তাহাঁর ফলাফল হচ্ছে পানি তোলার বালতির মত। কখনো তোমাদের বিরুদ্ধে তারা জয়লাভ করে আবার কখনো তাহাদের বিরুদ্ধে তোমরা জয়লাভ কর। এমনিভাবেই রসূল [সাঃআঃ]দের পরীক্ষা করা হয়, তারপর চূড়ান্ত বিজয় তাহাদেরই হয়ে থাকে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেন কিনা? তুমি বলেছ, না। তদ্রূপ রসূল [সাঃআঃ]গণ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেন না। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাহাঁর পূর্বে কেউ এ দাবী উত্থাপন করেছিল কিনা? তুমি বলেছ, না। আমি বলি যদি কেউ তাহাঁর পূর্বে এ ধরনের দাবী করে থাকত তাহলে আমি মনে করতাম এ ব্যক্তি পূর্ববর্তী দাবীর অনুসরণ করছে। আবু সুফ্ইয়ান বলেন, তারপর তিনি জিজ্ঞেস করিলেন, তিনি তোমাদের কী কাজের হুকুম দেন? আমি বললাম, সলাত কায়িম করিতে, যাকাত প্রদান করিতে, আত্মীয়তা রক্ষা করিতে এবং পাপকাজ থেকে পবিত্র থাকার হুকুম দেন। হিরাক্লিয়াস বলিলেন, তাহাঁর সম্পর্কে তোমার বক্তব্য যদি সঠিক হয়, তাহলে তিনি ঠিকই নাবী [সাঃআঃ], তিনি আবির্ভূত হইবেন তা আমি জানতাম বটে তবে তোমাদের মধ্যে আবির্ভূত হইবেন তা মনে করিনি। যদি আমি তাহাঁর সান্নিধ্যে পৌঁছার সুযোগ পেতাম তাহলে আমি তাহাঁর সাক্ষাৎকে অগ্রাধিকার দিতাম। যদি আমি তাহাঁর নিকট অবস্থান করতাম তাহলে আমি তাহাঁর পদযুগল ধুয়ে দিতাম। আমার পায়ের নিচের জমিন পর্যন্ত তাহাঁর রাজত্ব সীমা পৌঁছে যাবে।

আবু সুফ্ইয়ান বলেন, তারপর হিরাক্লিয়াস রাসূলুল্লাহ [সাঃআঃ]-এর পত্রখানি আনতে বলিলেন। এরপর পাঠ করিতে বলিলেন। তাতে লেখা ছিলঃ

দয়াময় পরম দয়ালু আল্লাহ্‌র নামে, আল্লাহ্‌র রসূল মুহাম্মাদ [সাঃআঃ]-এর পক্ষ থেকে রোমের অধিপতি হিরাক্লিয়াসের প্রতি। হিদায়াতের অনুসারীর প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। এরপর আমি আপনাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি, ইসলাম গ্রহণ করুন, মুক্তি পাবেন। ইসলাম গ্রহণ করুন, আল্লাহ তাআলা আপনাকে দ্বিগুণ প্রতিদান দেবেন। আর যদি মুখ ফিরিয়ে থাকেন তাহলে সকল প্রজার পাপরাশিও আপনার উপর নিপতিত হইবে। হে কিতাবীগণ! এসো সে কথায়, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই যে, আমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদাত করব না, কোন কিছুতেই তাহাঁর সঙ্গে শরীক করব না। আর আমাদের একে অন্যকে আল্লাহ ব্যতীত প্রতিপালকরূপে গ্রহণ করব না। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে বল, তোমরা সাক্ষী থাক, আমরা মুসলিম।

যখন তিনি পত্র পাঠ সমাপ্ত করিলেন চতুর্দিকে উচ্চ রব উঠল এবং গুঞ্জন বৃদ্ধি পেল। তারপর তাহাঁর নির্দেশে আমাদের বাইরে নিয়ে আসা হল। আবু সুফ্ইয়ান বলেন, আমরা বেরিয়ে আসার পর আমি আমার সাথীদের বললাম যে, আবু কাবশার সন্তানের তো বিস্তর ঘটেছে। রোমের রাষ্ট্রনায়ক পর্যন্ত তাঁকে ভয় পায়। তখন থেকে আমার মনে এ দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল যে, রাসূলুল্লাহ [সাঃআঃ]-এর দ্বীন অতি সত্বর বিজয় লাভ করিবে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা আমাকে ইসলামে দীক্ষিত করিলেন।

বোখারী পর্ব ৬৫ অধ্যায় ৩ হাদীস নং ৪৫৫৩; মুসলিম ৩২/২৬ হাঃ ১৭৭৩

Was this article helpful?

Related Articles