দাজ্জাল ও কিয়ামতের নিদর্শনের বর্ণনা

বিবিধ ও আকর্ষণীয় বিষয়ক হাদীস

১৮১০. হযরত নাওয়াস ইবনে সাময়ান (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (স) ‘দাজ্জাল’ সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি কখনো বিষয়টি অবজ্ঞার সুরে প্রকাশ করেন আবার কখনো গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেন। এমন কি আমাদের ধারণা হল দাজ্জাল খেজুর বাগানের কোন এক স্থানে লুকিয়ে রয়েছে। যখন আমরা তাঁর নিকট হতে ফিরে যাচ্ছিলাম তিনি আমাদের প্রকৃত অবস্থা বুঝে ফেললেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কি হয়েছে? আমরা বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ (স)! আপনি সকাল বেলা দাজ্জাল সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন। আপনি তা অবজ্ঞাভরে এবং কখনো গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করেছিলেন। এতে আমাদের ধারণা হয়েছিল, সম্ভবত ঐ সময়ে দাজ্জাল খেজুর বাগানের কোথাও অবস্থান করছে। তিনি বলেন, তোমাদের ব্যাপারে আমি দাজ্জালের ফিতনার খুব একটা আশঙ্কা করি না। যদি আমার উপস্থিতিতে সে আত্মপ্রকাশ করে তবে আমি নিজে তোমাদের পক্ষ হতে তার বিপক্ষে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াব। আর যদি আমার অবর্তমানে সে আত্মপ্রকাশ করে তবে প্রত্যেকে নিজেরাই তার বিপক্ষে দাঁড়াতে হবে। মহান আল্লাহ আমার অর্বতমানে তোমাদের রক্ষক। দাজ্জাল ছোট ছোট কোঁকড়ানো কেশবিশিষ্ট যুবক। তার চোখ হবে ফোলা। আমি তাকে আবদুল ওযযা ইবনে কাতান সদৃশ মনে করি। যে ব্যক্তি তার সাক্ষাৎ পাবে সে যেন সূরা কাহাফের প্রাথমিক আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করে। দাজ্জাল শাম ও ইরাকের সাথে সংযোগে রক্ষাকারী রাস্তায় আত্মপ্রকাশ করবে। সে তার ডানে ও বায়ে হত্যা, ধ্বংস ও ফিতনা ফাসাদ ছড়াবে। হে আল্লাহ বান্দাগণ! অটল ও স্থির হয়ে থেক। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! সে কত সময় দুনিয়াতে বর্তমান থাকবে? তিনি বলেন, চল্লিশ দিন। এর একদিন হবে, এক বছরের সমান, একদিন হবে এক মাসের সমান এবং একদিন হবে এক সপ্তাহের সমান। অবশিষ্ট দিনসমূহ তোমাদের এ দিনের কি মতই দীর্ঘ হবে। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! দুনিয়াতে দাজ্জাল কত দ্রুত গতি সম্পন্ন হবে? তিনি বলেন, বায়ুতাড়িত মেঘের মত দ্রুত গতি সম্পন্ন হবে। সে এক সম্প্রদায়ের নিকট আসবে এবং তাদেরকে নিজের দিকে আহবান জানাবে। তারা তার প্রতি ঈমান স্থাপন করবে এবং তার হুকুমের অনুসরণ করবে। সে আকাশকে নির্দেশ দেবে। আকাশ তাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করবে। সে যমীনকে আদেশ দেবে এবং যমীন উদ্ভিদ উৎপাদন করবে। তাদের গৃহপালিত জন্তুরা সন্ধ্যায় ঘরে ফিরবে। এগুলোর কুঁজ সু্উচ্চ, দুধের বাঁটগুলো লম্বা এবং স্ফীত হবে। এরপর সে আর এক সম্প্রদায়ের কাছে আগমন করবে এবং তাদরকে নিজের দিকে আহ্বান জানাবে। তারা তার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করবে। দাজ্জাল তাদের কাছ হতে চলে যাবে। তারা অতি দ্রুত অজন্মা ও দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হবে। তাদের হাতে ধন-সম্পদ কিছুই অবিশষ্ট থাকবে না। দাজ্জাল এ বিধ্বস্ত অঞ্চল দিয়ে অতিক্রম করার সময় বলবে, তোমার গচ্ছিত সম্পদরাজি বের করে দাও। সাথে সাথে সে অঞ্চলের ধন- সম্পদ মধু মক্ষিকার মতো তার অনুসরণ করবে। এরপর সে পূর্ণ বয়স্কা এক যুবককে আহ্বান জানাবে। (কিন্তু সে তাকে অস্বীকার করবে।) দাজ্জাল তাকে তরবারী দিয়ে দু’টুকরা করে ফেলবে। এরপর টুকরা দু’টিকে আলাদাভাবে একটি তীরের পাল্লা পরিমাণ দূরত্বে থাকবে। এরপর সে ডাকবে এবং টুকরো দু’টি চলে আসবে। তার চেহারা তখন প্রফুল্ল ও হাস্যময় হবে। ইত্যবসরে আল্লাহ তায়ালা মাসীহ ইবনে মরিয়াম (আ) -কে প্রেরণ করলেন। তিনি দামেস্কের পূর্ব অংশে সাদা মিনারের উপরে হালকা জাফরানী (হলুদ) রং এর কাপড় পরিহিত অবস্থায় ফেরেশতারা কাঁধে ভর দিয়ে নেমে আসবেন। যখন তিনি মাথা অবনত করবেন তখন মনে হবে যেন তার মাথায় মুক্তার মত পানির বিন্দু টপকাচ্ছে। যখন তিনি মাথা উঠাবেন তখনো তাঁর মাথা হতে মতির দানার মতো ঝরছে বলে মনে হবে। যে কাফেরের গায়ে তাঁর নিঃশ্বাস লাগবে তার বেঁচে থাকা সম্ভব হবে না। (সঙ্গে সঙ্গে মারা যাবে) ।    তাঁর দৃষ্টি যতদূরে যাবে তার নিঃশ্বাস ততদূর পৌঁছবে। তিনি দাজ্জালকে পিছু ধাওয়া করবেন এবং লুদ নামক স্থানে তাকে হত্যা করবেন। এরপর ঈসা (আ) ঐসব ব্যক্তিদের কাছে আসবেন যাদেরকে আল্লাহ দাজ্জালের ফিতনা হতে নিরাপদে রেখেছেন। তিনি তাদের চেহারা হতে মলিনতা দূর করে দেবেন এবং বেহেশতে তাদের যে মর্যাদা হবে তা বর্ণনা করবেন। ইত্যবসরে মহান আল্লাহ হযরত ইসা (আ) -এর কাছে এ মর্মে হুকুম করবেন, আমি এমন একদল বান্দাকে পাঠিয়েছি যাদের বিপক্ষে অস্ত্রধারণ করার শক্তি কারো হবে না। তুমি আমার এসব বান্দাকে নিয়ে তূর পাহাড়ে চলে যাও। এরপর মহান আল্লাহ ইয়াজুজ মাজূজের সম্প্রদায়কে পাঠাবেন। তারা প্রত্যেক উচ্চভূমি হতে দ্রুত বেগে বেরিয়ে আসবেন। তাদের অগ্রবর্তী দলসমূহ তাবারিয়া হ্রদের উপর দিয়ে অতিক্রম করবে। তারা এ হ্রদের সব পানি পান করে ফেলবে। তাদের পরবর্তী দলও এ অঞ্চল দিয়ে অতিক্রম করবে। তারা বলবে এখানে কোন এক সময়ে পনি ছিল। আল্লাহর নবী হযরত ঈসা (আ) ও তাঁর সাথীরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়বেন। এমন সময় তাদের কাছে গরুর একটি মাথা এত মূল্যবান মনে হবে যেমন বর্তমানে তোমরা একশ’ দীনারকে মূল্যবান মনে কর। তখন আল্লাহর নবী হযরত ঈসা (আ) ও তাঁর সঙ্গীগণ (রা) আল্লাহর কাছে বিনীতভাবে ফরিয়াদ করবেন। আল্লাহ তায়ালা তাদের (ইয়াজুজ-মাজুজ) প্রত্যেকের ঘাড়ে এক ধরনের কীট সৃষ্টি করে দেবেন। ফলে তারা সবাই এক সাথে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এরপর আল্লাহর নবী ঈসা (আ) ও তাঁর সঙ্গীগণ পাহাড় থেকে জনপদে নেমে আসবেন। কিন্তু তাঁরা পৃথিবীতে এক ইঞ্চি জায়গাও ইয়াজুজ মাজূজের লাশ ও এর দুর্গন্ধ ব্যতীত ফাকা পাবেন না। এরপর আল্লাহর নবী ইযরত ঈসা (আ) ও তাঁর সাহাবা (রা) আল্লাহর কাছে কাতরভাবে প্রার্থনা করবেন। আল্লাহ তায়ালা বুখতী উটের কুজ সদৃশ পাখি প্রেরণ করবেন। এসব পাখি লাশসমূহকে উঠিয়ে আল্লাহ যেখানে ফেলে দেয়ার নির্দেশ দেবেন সেখানে ফেলে দেবে। এরপর মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ এমন বৃষ্টি প্রেরণ করবেন যা প্রতিটি স্থান, তা মৃত্তিকাই হোক অথবা বালি ধুয়ে আয়নায় মত পরিস্কার করে দেবেন। এরপর ভূমিকে বলা হবে, তোমরা ফল উৎপাদন কর এবং কল্যাণ ফিরিয়ে নাও (এত বরকত, কল্যাণ ও প্রাচুর্য দেখা দিবে) একটি ডালিম খেয়ে পূর্ণ একটি দল পরিতৃপ্ত হবে এবং ডালিমের খোসাটি এত বড় হবে যে তার ছায়ার তারা আশ্রয় নিতে পারবে। গবাদি পশুতেও এত প্রাচুর্য দেয়া হবে যে একটি দুধের উটের দুধ হবে একটি বড় দলের জন্য যথেষ্ট। একটি দুধের গাভীর দুধ একটি গোত্রের জন্য যথেষ্ট হবে এবং একটি দুধের বকরী পরিবারের জন্য যথেষ্ট হবে। এ সময় আল্লাহ তায়ালা পবিত্র বায়ু প্রবাহিত করবেন। এ বায়ু তাদের বগলের নিচ পর্যন্ত লাগবে। ফলে সকল মু’মিন ও মুসলমানের রূহ কবজ হয়ে যাবে। শুধু মন্দ ব্যক্তিরাই বেঁচে থাকবে। তারা পশুর মত প্রকাশ্যে সহবাস করবে। তাদের বর্তমানেই কেয়ামত সংঘটিত হবে। (মুসলিম)


১৮১১. হযরত রিবয়ী ইবনে হিরাশ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আবু মাসউদ আনসারী সাথে হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান (রা) -এর কাছে এলাম। আবু মাসউদ (রা) তাঁকে বলেন, আপনি দাজ্জাল সম্বন্ধে রাসূলুল্লাহ (স) -এর কাছে যা শুনেছেন তা আমাকে বলুন। তিনি বলেন, দাজ্জাল আবির্ভাব হবে এবং তার সাথে পানি ও আগুন থাকবে। কিন্তু লোকজন যে পানি দেখতে পাবে তা হবে মূলত জ্বলন্ত আগুন। আর লোকজন তার সাথে যে আগুন দেখতে পাবে তা হবে মূলত সুপেয় ঠান্ডা পানি। এ হাদীস শুনে আবু মাসউদ (রা) বলেন, আমিও মহানবী (স) কে এ কথা বলতে শুনেছি। (বুখারী ও মুসলিম)


১৮১২. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আ’স (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে দাজ্জালের আবির্ভাব হবে এবং সে চল্লিশ পর্যন্ত অবস্থান করবে। বর্ণনাকারী বলেন, নবী করীম (স) চল্লিশ দিন, না চল্লিশ মাস, না চল্লিশ বছর বলেছেন তা আমার মনে নেই। এরপর আল্লাহ তায়ালা হযরত ঈসা ইবনে মারেয়াম (আ) -কে প্রেরণ করবেন। তিনি দাজ্জালকে খুঁজে বের করে হত্যা করবেন। এরপর মানুষ সাত বছর এমনভাবে কাটাবে যে দু’জনের মধ্যেও কোন রকম শত্রুতা থাকবে না। মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ শামের দিক গতে একটি শীতল বায়ু প্রবাহিত করবেন। ফলে দুনিয়ার বুকে এমন কোন ব্যক্তি অবশিষ্ট থাকবে না যার মধ্যে সামান্য পরিমাণ সৎকাজের আগ্রহ বা ঈমান রয়েছে; বরং এ প্রকারের সকল ব্যক্তিদের রূহ কবজ করবে। এরপর শুধু দৃষ্কৃতরীরাই বেঁচে থাকবে। তারা যৌনতা ও কুপ্রবৃত্তির বেলায় পাখির মত এবং জুলুম অত্যাচারের বেলায় হিংস্র জন্তুর মত হবে। তারা পুণ্য কর্ম বলতে কিছুই করবে না এবং খারাপ কাজ বলতে কোনটাই না করে ছাড়বে না। শয়তান মানুষের রূপ ধরে তাদের কাছে আসে বলবে, তোমরা কি আমার কথা মানবে? তারা বলবে, তুমি আমাদের কি কাজ করতে বল? তখন শয়তান তাদেরকে মূর্তি পূজার নির্দেশ দেবে। মূর্তি পূজা চলাকালীন সময়ে তাদের খাদ্য দ্রব্যের বৃদ্ধি পেতে থাকবে; জীবনটা অত্যন্ত বিলাসী ও আনন্দ উল্লাসময় হবে। এরপর শিংগায় ফুঁ দেয়া হবে। যে ব্যক্তি শিংগার শব্দ শুনতে পাবে, সে ঘাড় বাঁকিয়ে সে দিকে তাকাবে এবং ঘাড় উঠাবে। সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি আওয়াজ শুনতে পাবে সে তখন তার উটের পানির চৌবাচ্চ পরিস্কার করতে থাকবে। এরপর সে অজ্ঞান হয়ে পড়বে এবং তার আশে পাশের লোকজনও অজ্ঞান হয়ে যাবে। এরপর মহান আল্লাহ শিশির বিন্দুর ন্যায় বৃষ্টি প্রেরণ করবেন। অথবা তিনি বলেছেন, মুষলধারে বৃষ্টি অবর্তীণ করবেন। এর প্রভাবে মানবের শরীর গঠিত হয়ে উঠবে। তখন বলা হবে হে লোক সকল! তোমাদের রবের কাছে এসো। এরপর (হুকুম দেয়া হবে) তাদের দাঁড় করাও। কেননা, তাদের পুংখানুপুংখরূপে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এরপর বলা হবে, এদের হতে দোযখের অংশটি বের করে ফেল। বলা হবে কি পরিমাণ? বলা হবে, প্রতিহাজারে নয়শ নিরানব্বই জন (একজন মাত্র বেহেশতী) ।   এটাই সেই দিন তরুন বালক বৃদ্ধ হয়ে যাবে। সে দিন সব কিছু স্পষ্ট করে উপস্থাপন করা হবে। (মুসলিম)


১৮১৩. হযরত আসান (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, মক্কা মদীনা শরীফাইন ছাড়া এমন কোন জনপদ অবশিষ্ট থাকবে না দাজ্জাল যেখানে পদদলিত করবে না। এ দুই পবিত্র নগরীর প্রতিটি প্রবেশদ্বারে ফেরশতারা কাতারবন্দি হয়ে পাহারা দিতে থাকবে। দাজ্জাল সাবখাহ নামক স্থানে এসে পৌঁছলে মদীনাতে তিনবার ভূমিকম্প হবে। এরূপে মহান আল্লাহ সব কাফের ও মুনাফেকদের মদীনা হতে বের করে দিবেন। (মুসলিম)


১৮১৪. হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, ইস্পাহানের সত্তর হাজার ইয়াহূদী দাজ্জালে অনুসারী হবে। এরা সবুজ রং-এর চাদর পরিহিত হবে। (মুসলিম)


১৮১৫. হযরত  উম্মে শারীফ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি নবী করীম (স) কে বলতে শুনেছেন, দাজ্জালের ভয়ে লোকজন পাহাড়ের দিকে পলায়ন করতে থাকবে। ( মুসলিম)


১৮১৬. হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ (স) কে বলতে শুনেছি । তিনি বললেন, “হযরত আদম (আ)-এর জন্ম হতে মহাপ্রলয় পর্যন্ত সময়ের মধ্যে দাজ্জালের বিপর্যয় ও ফিতনার চেয়ে বিরাট ফিতনা আর কোন কিছুই হবে না। (মুসলিম)


১৮১৭. হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) নবী করীম কর্তৃক বর্ণনা করেছেন। নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেন, দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ করলে ঈমানদার ব্যক্তিদের মধ্যে এক ব্যক্তি তার কাছে যাবে। তার সাথে দাজ্জালের প্রহরীদের দেখা হবে। তারা তাকে বলবে, কোথায় যাওয়ার ইচ্ছা করছ? সে বলবে আমি এই আবির্ভূত ব্যক্তির কাছে যেতে ইচ্ছা করছি। প্রহরীর বলবে, আমাদের রবের প্রতি কি তোমাদের ঈমান নেই? সে বলবে আমাদের রবের ব্যাপারে তো কোনরূপ গোপনীয়তা নেই। তারা বলবে, একে হত্যা কর। কিন্তু এদের মধ্যে কেউ কেউ বলাবলি করবে, তোমাদের রব কি তোমাদেরকে তার অগোচরে কোন ব্যক্তিকে হত্যা করতে নিষেধ করেননি? সুতরাং তারা তাকে দাজ্জালের কাছে নিয়ে যাবে। যখন মু’মিন ব্যক্তি দাজ্জালকে দেখবে তখন বলবে হে লোক সকল! এই তো সেই দাজ্জাল যার প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (স) বলে গেছেন। এরপর দাজ্জালের নির্দেশে তার দেহ হতে মাথা বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। তার পেট ও পিঠ উন্মুক্ত করে পিটানো হবে আর বলা হবে, তুমি কি আমার প্রতি ঈমান স্থাপন কর না? উত্তরে মু’মিন ব্যক্তি বলবে, তুমিই তো সেই মিথ্যাবাদী মাসীহ দাজ্জাল। সুতরাং তার নির্দেশে মু’মিন ব্যক্তির মাথার সিথি হতে দু’পায়ের মধ্য পর্যন্ত করাত দিয়ে চিরে দু’টুকরা করা হবে। দাজ্জাল তার দেহের এ দুই অংশের মধ্য দিয়ে এদিক হতে ওদিকে গমন করবে। এরপর সে মু’মিন ব্যক্তির দেহকে সম্বোধন করে বলবে পূর্বের মত হয়ে যাও। তখন সে আবার পরিপূর্ণ মানব হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। আবার সে বলবে এখন কি তুমি ঈমান পোষণ কর? মু’মিন মানবটি বলবে তোমার সম্পর্কে এখন আমি আরো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। সে মানবদেরকে ডেকে বলবে, হে মানবমণ্ডলী! আমার পর এ আর কারো কিছু করতে পারবে না। দাজ্জাল পুনরায় তাকে হত্যা করতে চাইবে। কিন্তু আল্লাহ তার ঘাড়কে গলার নিচের হাড় পর্যন্ত পিতলে মুড়িয়ে দেবেন। ফলে সে তাকে হত্যা করার আর কোন উপায় পাবে না। বাধ্য হয়ে সে তার দু’হাত ও দু’পা ধরে ছুঁড়ে ফেলবে। মানুষে ধারণা করবে দাজ্জাল তাকে আগুনে নিক্ষেপ করেছে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সে বেহেশতে নিক্ষিপ্ত হবে। রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, এই ব্যক্তি বিশ্ব জগতের রব আল্লাহর কাছে মানবের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত স্তরের শহীদের মর্যাদা লাভ করবে। ( মুসলিম)


১৮১৮. হযরত মুগীরা ইবনে শু’বা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, দাজ্জালের ব্যাপারে আমি রাসূলুল্লাহ (স) কে যত বেশি প্রশ্ন করেছি; অন্য কেউ তত প্রশ্ন করেনি। তিনি আমাকে বলেছেন, সে তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আমি বললাম, লোকজন বলে থাকে যে তার সাথে রুটির পাহাড় এবং পানির ঝর্ণা থাকবে। তিনি বলেন, আল্লাহর কাছে এটা সামান্য তুচ্ছ ব্যাপার। ( বুখারী ও মুসলিম)


১৮১৯. হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, প্রত্যেক নবী তাঁর উম্মতকে কানা মিথ্যাবাদী (দাজ্জাল) সম্পর্কে সর্তক করেছেন। সাবধান! সে কানা। তোমাদের মহান ও শক্তিমান রব অন্ধ নন। সেই কানা মিথ্যাবাদী দাজ্জালের কপালে কাফ্‌ ফা এবং রা লিপিবদ্ধ থাকবে (কাফির) । ( বুখারী ও মুসলিম )


১৮২০. হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, আমি কি তোমাদেরকে দাজ্জাল সম্পর্কে এমন কথা বলব না যা অপর নবী তাঁর উম্মাতকে বলেন নি। সে হবে কানা এবং সে তার সাথে দোযখের মত একটি এবং বেহেশতের মত একটি বস্তু নিয়ে আসবে। সে যাকে বেহেশত বলে পরিচয় দেবে সেটা হবে প্রকৃতপক্ষে দোযখ। তেমনিভাবে তার সাথের দোযখটি হবে প্রকৃতিপক্ষে বেহেশত। (বুখারী ও মুসলিম)


১৮২১. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স) লোকদের নিকট দাজ্জাল সম্পর্কে আলাপ করছিলেন। তিনি বলেন, মহান আল্লাহ এক চক্ষুবিশিষ্ট নন। কিন্তু মাসীহ দাজ্জালের ডান চক্ষু কানা,  তার চোখ আঙ্গরের দানার মত ফোলা হবে। (বুখারী ও মুসলিম )


১৮২২. হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, মুসলমানেরা ইয়াহূদীদের বিপক্ষে যুদ্ধ না করা পর্যন্ত কেয়ামত সংঘটিত হবে না। এমনকি পরাজিত হয়ে ইয়াহুদীরা মুসলমানদের ভয়ে পাথর ও বৃক্ষের আড়ালে আত্মগোপন করবে। কিন্তু বৃক্ষ এবং পাথরও বলে উঠবে হে মুসলিমগণ! এখানে ইয়াহূদী আমার পেছনে লুকিয়ে আছে। তুমি এসে হত্যা কর। কিন্তু ‘গারকাদ’ নামক গাছ তা বলবে না। কেননা ঐটা ইয়াহূদীদের গাছ। (বুখারী ও মুসলিম)


১৮২৩. হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, সেই সত্তার শপথ যাঁর হাতে আমার জান। দুনিয়া ততদিন ধ্বংস হবে না যত দিন না কোন ব্যক্তি কোন কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে এবং ফিরে কবরের পাশে গিয়ে বলবে, হায়! এই কবরবাসীর বদলে আমি যদি এ কবরে থাকতাম, তবে কতই না ভাল হত। প্রকৃতপক্ষে তার কাছে দ্বীন ইসলামের কিছুই থাকবে না বরং বিপদাপদে অতিষ্ঠ হয়ে সে একথা বলবে। (বুখারী ও মুসলিম )


১৮২৪. হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, কেয়ামত তত দিন পর্যন্ত সংঘটিত হবে না; যতদিন না ফোরাত নদী হতে স্বর্ণের একটি পর্বতের আবির্ভাব হবে এবং তার দখল নিয়ে লোকদের মাঝে যুদ্ধ হবে প্রতি একশ’ জনের নিরানব্বইজন নিহত হবে। এদের প্রতিটি ব্যক্তিই বলবে, আশা করি আমিই হব সেই ব্যক্তি বেঁচে থাকবে। অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে, অচিরেই ফোরাত নদিতে স্বর্ণের খনি পাওয়া যাবে। যে ব্যক্তিই তখন সেখানে উপস্থিত থাকবে সে তা থেকে কিছুই গ্রহণ করবে না। (বুখারী ও মুসলিম)


১৮২৫. হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (স) কে বলতে শুনেছি। তিনি বলেন, (কেয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে) মানবজন মদীনা শহরকে ভাল অবস্থায় ছেড়ে চলে যাবে। মদীনা জুড়ে থাকবে তখন শুধু হিংস্র বন্য জন্তু ও পাখি। পরিশেষে মুযায়না গোত্রের দু’জন রাখাল মেষ বকরী নিয়ে মদীনায় প্রবেশের জন্য আগমন করবে। কিন্তু তারা দেখতে পাবে বন্য হিংস্র জন্তুতে মদীনা ভরপুর হয়ে রয়েছে। (তারা ফিরে চলে যাবে)।  যখন তারা ‘সানিয়াতুল বিদা’ নামক পাহাড়ের কাছে পৌঁছবে তখন হুমড়ি খেয়ে পড়ে মারা যাবে। (বুখারী ও মুসলিম)


১৮২৬. হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেন, শেষ যুগে তোমাদের একজন খলিফা (ইসলাম রাষ্ট্র প্রধান) হবে। সে প্রচুর ধন-সম্পদ দু’হাতে বিলিয়ে দেবে কিন্তু হিসাব রাখবে না। (মুসলিম)


১৮২৭. হযরত আবু মূসা আশয়ারী থেকে বর্ণিত। নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেন, মানুষের ওপর এমন এক যুগ আসবে যখন এক জন লোক যাকাত নিয়ে ঘুরে বেড়াবে কিন্তু গ্রহণ করার মত কোন ব্যক্তি খুজেঁ পাবে না। সে সময় দেখা যাবে পুরুষের সংখ্যাস্বল্পতা ও নারীর সংখ্যাধিক্য। এক জন পুরুষকে চল্লিশজন নারী যৌন চরিতার্থ করার জন্য অনুসরণ করবে। (মুসলিম)


১৮২৮. হযরত আবু হোরায়রা (রা) নবী করীম (স) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির কাছ হতে কিছু জমি ক্রয় করেছিল। ক্রেতা ভূমির মধ্যে স্বর্ণ কলসী পেল। সে বিক্রেতাকে বলল, আপনি আপনার কলসী ফেরত নিন। কেননা, আমি আপনার কাছ হতে কেবল ভূমি ক্রয় করেছি, স্বর্ণ ক্রয় করিনি। ভূমি বিক্রতা বলল, আমি তো আপনার কাছে জমি এবং এর মধ্যে যা রয়েছে সবই বিক্রি করেছি। তখন উভয়ে মীমাংসার জন্য তৃতীয় এক ব্যক্তির কাছে গেল। মীমাংসাকারী উভয়কে জিজ্ঞেস করেন, তোমাদের কি কোন সন্তান-সন্ততি রয়েছে? একজন বলল, আমরা এক ছেলে রয়েছে। অপরজন বলল, আমার এক মেয়ে রয়েছে। তখন মীমাংসাকারী বলেন, ছেলেকে কন্যার সঙ্গে বিয়ে দাও এবং তাদের উভয়ের জন্য এ সম্পদ খরচ কর (বুখারী ও মুসলিম)


১৮২৯. হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল্লাহ (স) কে বলতে শুনেছেন, অতীত জামানায় দু’জন স্ত্রীলোক ছিল। তাদের সাথে দু’টি সন্তানও ছিল। একটি বাঘ এসে তাদের একজনের সন্তানকে নিয়ে গেল। তাদের এক স্ত্রীলোক অপর স্ত্রীলোককে বলল, তোমার সন্তানকেই বাঘে নিয়েছে। অপরজন বলল, তোমার সন্তানকেই বাঘে নিয়েছে। তারা উভয়ে মীমাংসার জন্য হযরত দাউদ (আ) -এর কাছে গেল। তিনি বড় স্ত্রীলোকটির পক্ষে রায় দিলেন। সুতরাং তারা উভয়ে সেখান হতে বেরিয়ে হযরত সুলাইমান ইবনে দাউদ (আ) এর কাছে এসে তাঁকে ঘটনাটি বলল। তিনি তাঁর সঙ্গীদের বললেন, একটি ছুরি এনে দাও, আমি এ বাচ্চাটিকে কেটে দুজনকে ভাগ করে দেব। একথা শুনে ছোট স্ত্রী লোকটি বলল, আল্লাহ আপনার প্রতি অনুগ্রহ করুন,এরূপ করবেন না। শিশুটি তারই। (তাই তাকেই দিয়ে দিন)।   এ সময়ে বড় স্ত্রীলোকটি চুপ করে ছিল। তাই ছোট স্ত্রীলোকটির পক্ষে রায় দিলেন। (বুখারী ও মুসলিম)


১৮৩০. হযরত মিদরাস আল আসলামী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম ( স) ইরশাদ করেছেন, পুণ্যবান ব্যক্তিরা একের পর এক মৃত্যুবরণ করতে থাকবে এবং যবের ভূষি অথবা খেজুরের ছালের ন্যায় অপদার্থ ও অকেজো ব্যক্তিরা বেঁচে থাকবে। আল্লাহ তাদের কোন পরোয়াই করবেন না। ( বুখারী )


১৮৩১. হযরত রিফায়া ইবনে রাফি’ আয-যুরাকী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বললেন, একবার হযরত জিবরীল (আ) নবী করীম (স)-এর কাছে এসে বললেন, আপনাদের মধ্যে বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী   ব্যক্তিদের মর্যাদা কিরূপ? তিনি বলেন, তাঁরা মুসলমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। অথবা (বর্ণনাকারীর সন্দেহ) তিনি অনুরূপ অর্থবোধক অপর কোন কথা বলেছেন। হযরত জিবরীল (আ) বলেন, অনুরূপভাবে বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ফেরেশতাদের মর্যাদাও অপর সকল ফেরেশতাদের ঊর্ধ্বে। (বুখারী)


১৮৩২. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তায়ালা যখন কোন কওমের উপর শাস্তি অবতীর্ণ করেন, তখন তাদের প্রতিটি ব্যক্তি ঐ শাস্তিতে নিপতিত হয়। কেয়ামতের দিন এসব ব্যক্তিকে তাদের কার্যকলাপসহ উঠানো হবে। (বুখারী ও মুসলিম)


১৮৩৩. হযরত জাবের (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, মসজিদে নববীতে খেজুর বৃক্ষের একটি খুঁটি ছিল। তাতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে নবী করীম (স) (শুক্রবারে জুমু’আর) খুতবা দিতেন। যখন মিম্বর নির্মাণ করা হল তখন আমরা উক্ত গাছ হতে গর্ভবতী উটের মত বেদনাদায়ক আওয়াজ শুনতে পেলাম। তখন নবী করীম (স) মিম্বর হতে নেমে এসে সেটির উপর নিজের হাত মুবারক রাখলেন। তখন তার আওয়াজ থেমে গেল। অপর বর্ণনায় রয়েছে, শুক্রবার আসলে নবী করীম (স) জুমুয়ার খুতবা দিতে মিম্বরে উঠতেন। তখন খেজুরের খুঁটিটা চিৎকার শুরু করে দিত। এমনকি তা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হতো। এ খুঁটির পাশে দাঁড়িয়েই নবী করীম (স) খুতবা দিতেন। অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, ঐ খুঁটি ছোট বাচ্চার মত চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। নবী করীম (স) মিম্বর হতে নেমে এসে খুঁটিটিকে ধরলেন। তা পুনরায় এমন সব শিশুর মতো কাদঁতে লাগল যাদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে থামানো যায়। অবশেষে তার কান্না থেমে গেল। নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেন, বৃক্ষটি এজন্য কান্না করছিল, সে এতদিন যে আলোচনা শুনে আসছিল তা হতে বঞ্চিত হয়ে গেল। (বুখারী)


১৮৩৪. হযরত আবু সা’লাবা জুরসূম ইবনে নাসির (রা) রাসূলুল্লাহ (স) কর্তৃক বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের প্রতি কিছু বিষয় ফরয করেছেন। তা নষ্ট করো না; কিছু সীমা নিদির্ষ্ট করে দিয়েছেন, তা লঙ্ঘন করো না; কিছু বস্তু হারাম করেছেন, সেসবের মধ্যে লিপ্ত হয়ে পাপ করো না। আর তোমাদের প্রতি দয়া পরবশ হয়ে কিছু বস্তু সম্পর্কে ইচ্ছা করেই নীরব রয়েছেন, সেসব নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়ো না। (দারেকুতনী)


১৮৩৫. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আওফা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (স) -এর সাথে সাতটি গাযওয়ার (যুদ্ধে) অংশগ্রহণ করেছি। এ সময়ে আমরা টিড্ডি ভক্ষণ করি। অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, আমরা তার সাথে টিড্ডী ভক্ষণ করতাম। (বুখারী ও মুসলিম)


১৮৩৬. হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেন, “ঈমানদার ব্যক্তি একই গর্তে দু’বার দংশিত হয় না।” ( বুখারী ও মুসলিম)


১৮৩৭. হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, তিন প্রকারের ব্যক্তির সাথে আল্লাহ কেয়ামতের দিন কথা বলবেন না, তাদের প্রতি দৃষ্টি দিবেন না, তাদেরকে পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে পীড়াদায়ক শাস্তি। তারা হল, যে ব্যক্তির মালিকানাধীন বিস্তীর্ণ প্রান্তরে তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি রয়েছে, কিন্তু সে তা পথিক ভ্রমণকারীদের ব্যবহার করতে দেয় না। যে ব্যক্তি আসরের নামাযের পর কোন ব্যক্তির কাছে তার পণ্যদ্রব্য বিক্রি করতে গিয়ে আল্লাহর নামে শপথ করে বলল আমি এত এত মূল্যে ক্রয় করেছি। ক্রেতা তা বিশ্বাস করল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা উক্ত মূল্যে ক্রয় করেনি। (মিথ্যা কসম করেছে) ।   আর যে ব্যক্তি ইমামের কাছে শুধু সুযোগ-সুবিধা অর্জনের জন্য বাইয়াত গ্রহণ করল। যদি ইমাম তাকে কিছু পার্থিব স্বার্থ প্রদান করে তবে অনুগত থাকে আর না দিলে অনুগত থাকে না। ( বুখারী ও মুসলিম)


১৮৩৮. হযরত আবু হোরায়রা (রা) নবী করীম (স) থেকে বর্ণনা করেছেন। নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেন, শিঙ্গার দু’টি ফুৎকারের, মাঝে চল্লিশের ব্যবধান হবে। লোকজন জিজ্ঞেস করল হে আবু হোরায়রা! চল্লিশ দিনের ব্যবধান? তিনি বলেন, আমি অস্বীকার করলাম। লোকজন বলল, তবে কি চল্লিশ বছর? তিনি বলেন, আমি অস্বীকার করলাম। লোকজন  আবারও বলল, তবে কি চল্লিশ মাস? তিনি বলেন, এবারও আমি অস্বীকার করলাম। নবী করীম (স) আরও বলেন, মানুষের দেহের সব কিছু জরাজীর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু নিতম্বের হাড় নষ্ট হয় না। মানুষকে তার সাথে বিন্যাস করা হবে। এরপর আল্লাহ বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। ফলে মানব উদ্ভিদের মত গজিয়ে উঠবে। (বুখারী ও মুসলিম)


১৮৩৯. হযরত আবু হোরায়রা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (স) এক সমাবেশে জনতার সাথে কথা বলছিলেন। এমন সময় এক বেদুঈন এসে জিজ্ঞেস করল, কেয়ামতের কখন হবে? রাসূলুল্লাহ (স) বিরতি না দিয়ে কথা বলেই চললেন। উপস্থিত লোকদের কেউ কেউ বলতে লাগল, ব্যক্তিটির কথা তিনি শুনেছেন কিন্তু অপছন্দ করেছেন। কেউ কেউ বলল, তার কথা আদৌ শুনেননি। অবশেষে কথা বলা শেষ করে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কেয়ামত সম্পর্কে প্রশ্নকারী লোকটি কোথায়? সে বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি সেই লোক। তিনি বললেন,  যখন আমানত নষ্ট করে দেয়া হবে তখন কেয়ামতের জন্য অপেক্ষা কর। (বুখারী ও মুসলিম)


১৮৪০. হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, হুকুমতের নেতারা তোমাদের নামায কায়েম করবেন। যদি সঠিক মতো কায়েম করে তবে তারাও পুণ্য পাবে, তোমরাও পাবে। আর যদি ভুল পড়ায় তবে তোমরা পুণ্য পাবে, কিন্তু তারা পাপী হবে। (বুখারী)


১৮৪১. হযরত আবু হোরায়রা থেকে বর্ণিত। তিনি “আল্লাহ তায়ালার বাণী তোমরা হলে সর্বোত্তম উম্মত। তোমাদেরকে মানবজাতির পথপ্রদর্শনের জন্য কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত করা হয়েছে।” এ সম্পর্কে বলেন, মানুষদের জন্য সেই ব্যক্তি যে মানুষদের ঘাড়ে শিকল পরিয়ে নিয়ে আসে অবশেষে তারা ইসলাম প্রবেশ করে। (বুখারী)


১৮৪২. হযরত আবু হোরায়রা (রা) নবী করীম (স) থেকে বর্ণনা করেছেন। নবী (স) বললেন, মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ এমন একদলের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন যারা শিকল অবস্থায় বেহেশতে গমন করবে। (বুখারী)


১৮৪৩. হযরত আবু হোরায়রা (রা) নবী করীম (স) থেকে বর্ণনা করেছেন। নবী (স) ইরশাদ করেছেন, “শহরের মধ্যে মসজিদের স্থানসমূহ হচ্ছে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। আর শহরের মধ্যে বাজারের স্থানসমূহ হচ্ছে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি ঘৃণিত।” ( মুসলিম )


১৮৪৪. হযরত সালমান ফারসী (রা) -এর নিজের কথা হল, যদি তোমার পক্ষে সম্ভব হয় তাহলে বাজারে প্রথম গমনকারী এবং সর্বশেষ প্রস্থানকারী হয়ো না। কেননা, বাজার হচ্ছে শয়তাসের রণক্ষেত্র। শয়তান এখানে তার ঝাণ্ডা উত্তোলন করে রাখে। (মুসলিম) তবে বারকানী (র) তার সহীহ গ্রন্থে হযরত সালমান (রা) থেকে হাদীসটি এভাবে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, তুমি বাজারে সর্বপ্রথম এবং সর্বশেষ প্রস্থানকারী হয়ো না। কারণ সেখানে শয়তান ডিম পেড়ে বাচ্চা ফুটায়।


১৮৪৫. হযরত আসেম আল-আহওয়াল ও আবদুল্লাহ ইবনে সারজিস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (স)-কে বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আল্লাহ আপনার পাপ ক্ষমা করে দিন। তিনি বলেন, তোমার পাপও। আসেম (রা) বলেন, আমি তাঁকে (আবদুল্লাহ) বললাম রাসূলুল্লাহ (স) কি আপনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তোমার জন্যও তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। এরপর তিনি এই আয়াত তেলাওয়াত করেন, “আর ক্ষমা প্রার্থনা কর নিজের জন্য এবং ঈমানদার নারী ও পুরুষের জন্য।”


১৮৪৬. হযরত আবু মাসউদ আনসারী (রা) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেন, পূর্ববতী নবীদের উপদেশসূমহের মধ্যে যা লোকজনের কাছে পৌঁছেছে তা হল যদি তোমার লজ্জা না থাকে তাহলে যা ইচ্ছা করতে পারো। (বুখারী)


১৮৪৭. হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেন, কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম মানবের যে অপরাধের বিচার করা হবে তা হল হত্যা করার বিচার । ( বুখারী ও মুসলিম)


১৮৪৭. হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, ফেরেশতাদেরকে নূর হতে সৃষ্টি করা হয়েছে। জিনদেরকে আগুনের শিখা হতে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর আদম (আ) -কে সেই বস্তু দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে যা তোমাদের বর্ণনা করা হয়েছে। (মুসলিম)


১৮৪৯. হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, আল্লাহর নবী (স)-এর স্বভাব ছিল কুরআনের বাস্তব নমুনা। ইমাম মুসলিম (র) সুদীর্ঘ হাদীসটি বর্ণনা করা হয়েছে। (মুসলিম)


১৮৫০. হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ লাভ করা পছন্দ করে, আল্লাহর তার সাথে সাক্ষাৎ পছন্দ করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ লাভ পছন্দ করে না আল্লাহও তার সাথে সাক্ষাৎ পছন্দ করেন না। আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এর অর্থ কি মৃত্যুকে অপছন্দ করা? যদি তাই হয় তা আমাদের সবাই তো মৃত্যুকে অপছন্দ করে। তিনি বলেন, না এর অর্থ তা নয় বরং ঈমানদার ব্যক্তিকে আল্লাহর রহমত, সন্তুষ্টি ও তাঁর বেহেশতের সুখবর প্রদান করা হয়; তখন সে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ লাভকে অধিক পছন্দ করে। আর তাই আল্লাহর তার সাক্ষাৎ পছন্দ করেন। পক্ষান্তরে কাফের ব্যক্তিকে যখন লাভকে শাস্তি ও তাঁর অসন্তুষ্টির সুখবর দেয়া হয়, সে তখন আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভকে অপছন্দ করে। আর তাই আল্লাহও তার সাথে সাক্ষাতকে অপছন্দ করেন। (মুসলিম)


১৮৫১. হযরত উম্মুল মু’মিনীন সাফিয়া বিনতে হুয়াই (ইবনে আখতাব) (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (স) ইতিকাফ করছিলেন। আমি (একদিন) রাতে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য গেলাম। তাঁর সাথে কথাবার্তা বলে ফিরে আসার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। তিনিও আমাকে কিছু দূরে এগিয়ে দেয়ার জন্য সাথে আসলেন, ইতোমধ্যে দু’জন আনসার ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিল। নবী করীম (স)-কে দেখে তারা তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছিল। কিন্তু নবী করীম (স) তাদেরকে লক্ষ্য করে বলেন, একটু দাঁড়াও। (এরপর বললেন,) এ হল (আমার বিবি) সাফিয়া বিনতে হুয়াই। তারা বলে উঠল, সুবহানাল্লালাহ! (আল্লাহর মহা পবিত্র)! ইয়া রাসূলুল্লাহ! (আপনি এ কি বললেন!) তিনি বলেন, শয়তান আদম সন্তানের শিরা উপশিরা পর্যন্ত চলাচল করতে পারে। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, হয়তো শয়তান চলাচল করে তোমাদের মনে কু-ধারণা সৃষ্টি করবে। (বুখারী ও মুসলিম)


১৮৫২. হযরত আবুল ফযল আব্বাস ইবনে মুত্তালেব (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি হুনাইনের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (স) -এর সাথে ছিলাম। আমি এবং আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস ইবনে আবদুল মুত্তালেব (র) রাসূলুল্লাহ (স) -এর সাথে সাথে ছিলাম। আমরা তাঁর হতে কখনো বিছিন্ন হয়নি। রাসূলুল্লাহ (স) তার খচ্চরকে কাফেরদের দিকে হাঁকিয়ে নিতে থাকলেন। আমি রাসূলুল্লাহ (স) -এর খচ্চরের লাগাম টেনে ধরে বাধা দিচ্ছিলাম যাতে খচ্চরটি দ্রুত অগ্রসর হতে না পারে। হযরত আবু সুফিয়ান (রা) রাসূলুল্লাহ (স) -এর খচ্চরের রিকাব ধরেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, হে আব্বাস! বাইয়াতে অংশগ্রহণকারীদেরকে ডেকে আন। হযরত আব্বাস (রা) ছিলেন উচ্চ কন্ঠের অধিকারী। তিনি বললেন, আমি খুব উচ্চৈঃস্বরে এ বলে ডাকলাম। বাইয়াতে রিদওয়ানে অংশগ্রহণকারী কোথায়? আল্লাহর শপথ! আমার আহ্বান শোনার পর তাদের বাৎসল্য ও মমত্ব এমনভাবে সাড়া দিল যেমন গাভী তা সদ্য প্রসূত বাচ্চার প্রতি সাড়া দেয়। তারা সাড়া দিয়ে বলল, আমরা উপস্থিত আছি, আমরা উপস্থিত আছি। তারা কাফেরদের বিপক্ষে যুদ্ধে লিপ্ত হল। এ সময় সকলেই আনসারদেরকেও এ বলে আহ্বান জানাচ্ছিল, হে আনসারগণ! এরপর শুধু বনী হারেস ইবনে খাযরাজকে আহববান জানানো হয়। এ সময় রাসূলুল্লাহ (স) কিছু পাথরের টুকরা উঠিয়ে কাফেরদের দিকে নিক্ষেপ করেন এবং বলেন, মুহাম্মদের রবের শপথ! তারা পরাজিত হবে। এ সময় আমি যুদ্ধের অবস্থা দেখছিলাম। যুদ্ধ পূর্বের মতই চলছে। তবে আল্লাহর শপথ! তিনি যখনই তাদের প্রতি পাথরের টুকরোসমূহ নিক্ষেপ করেন, তখন আমি দেখলাম তাদের হামলার প্রচণ্ডতা ঝিমিয়ে পড়ল এবং তারা পরাজিত হয়ে পৃষ্ট প্রদর্শন করল। (মুসলিম)


১৮৫৩. হযরত আবু হোরায়রা থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, হে লোক সকল! আল্লাহ পবিত্র। তিনি হালাল বস্তু ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করেন না। আল্লাহ তায়ালা রাসূলদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছেন মু’মিনদেরকেও সেই নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর আল্লাহ তায়ালা বলেন,

“হে রাসূলুল্লাহ! পবিত্র বস্তু  ভক্ষণ কর পুণ্য কাজ কর। তোমরা যা কিছুই কর, আমি তা ভালভাবেই পরিজ্ঞাত। (সূরা মু’মিন)

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,

“হে ঈমানদারগণ আমি তোমাদেরকে যে হালাল রিযিক দিয়েছে তা ভক্ষণ কর।” (সূরা বাকারাঃ১৭২)


এরপর তিনি এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে আলোচনা করেন, যে দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করেছে। ফলে তার অবস্থা হয়েছে উসক খুসক ও ধূলিমলিন। এমতাবস্থায় সে তার দু’খানা হাত আসমানের দিকে প্রসারিত করে, হে রব! হে রব! বলতে থাকে। অথচ সে যা ভক্ষণ করে তা হারাম, যা পান করে তাও হারাম, যা পরিধান করে তাও হারাম। এক কথায় তার জীবন ধারনের সব কিছুই হারাম। সুতরাং কিভাবে তার দোয়া মঞ্জুর হতে পারে? (মুসলিম)


১৮৫৪. হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, তিন প্রকারের ব্যক্তির সাথে আল্লাহ মহাপ্রলয়ের দিন কথা বলবেন না, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন না, তাদের প্রতি দৃষ্টি দিবেন না। এবং তাদের জন্য রয়েছে মর্মান্তিক শাস্তি। তারা হল বৃদ্ধ ব্যভিচারী, মিথ্যাবাদী রাষ্ট্রনায়ক এবং অহংকারী দরিদ্র। (মুসলিম)


১৮৫৫. হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, সাইহান (সিহুন) জাইহান (জিহুন) ফোরাত (ইউফ্রেটিস) ও নীল এ চারটি বেহেশতের নদী। (মুসলিম)


১৮৫৬. হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (স) আমার হাত ধরে বলেন, আল্লাহ শনিবার দিন মৃত্তিকা সৃষ্টি করছেন, মঙ্গলবার দিন মন্দ বস্তুসমূহ সৃষ্টি করেছেন, বুধবার দিন নূর (আলো) সৃষ্টি করেছেন, বৃহস্পতিবার দিন জীবজন্তু সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টির শেষদিকে শুক্রবার দিন প্রহার আসর ও সন্ধ্যার মধ্যবর্তী সময়ে হযরত আদম (আ) কে সৃষ্টি করেছেন। (মুসলিম)


১৮৫৭. হযরত আবু সুলাইমান খালেদ ইবনে ওয়ালীদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বললেন, মুতার যুদ্ধের দিন আমার হাতে নয়খানা তরবারি ভেঙে যায়। সবশেষে আমার হাতে শুধুমাত্র একখান ইয়েমেনী তরবারি অবশিষ্ট। (বুখারী )


১৮৫৮. হযরত আমর ইবনুল আস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল্লাহ (স) কে বলতে শুনেছেন, কোন বিচারক মীমাংসা করার ব্যাপারে ইজতেহাদ বা গবেষণা করে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারলে তাকে দু’টি পুণ্য দেয়া হয়। আর ইজতেহাদ বা গবেষণা করে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হলে একটি পুণ্য দেয়া হয়। (বুখারী ও মুসলিম)


১৮৫৯. হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। নবী করীম ইরশাদ করেছেন, “জ্বর দোযখের প্রচন্ড উত্তাপের অংশ বিশেষ। তোমরা পানি দিয়ে তা ঠান্ডা করে নাও।” ( বুখারী ও মুসলিম)


১৮৬০. হযরত আয়েশা (রা) নবী করীম (স) থেকে বর্ণনা করেছেন। নবী (স) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ফরয রোযা রেখে মৃত্যুবরণ করল তার পক্ষ হতে তার ওয়ারিস বা অভিভাবক রোযা পালন করবে। (বুখারী ও মুসলিম )


১৮৬১. হযরত আওফ ইবন মালেক ইবনে তোফায়েল (রা) থেকে বর্ণিত। আয়েশা (রা) কে অবহিত করা হলো তাঁর কোন বস্তু বিক্রির ব্যাপারে কিংবা তিনি আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরকে যে হাদিয়া দিয়েছিলেন সে সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা) বললেন, আল্লাহর শপথ! আয়েশাকে এ কাজ হতে বিরত থাকতে হবে। তা না হলে আমি তাকে এভাবে অর্থ ব্যয় করতে বাধা দেব। একথা শুনে হযরত আয়েশা (রা) বলেন, সত্যই কি সে একথা বলেছে? লোকজন বলল, হ্যাঁ। তিনি বলেন, আল্লাহর নামে শপথ করলাম আমি কখনো আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের সাথে বাক্যালাপ করব না। যখন র্দীঘদিন ধরে তাঁদের উভয়ের মধ্যে বাক্যলাপ বন্ধ থাকল, তখন আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা) তাঁর কাছে সুপারিশ করতে লোক পাঠালেন। কিন্তু আয়েশা (রা) বলেন, আল্লাহর শপথ! আমি তার ব্যাপারে কোন সুপারিশ কবুল করব না এবং আমার মানতও ভঙ্গ করব না। আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের (রা) কাছে বিষয়টি যখন কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল, তখন তিনি মিসওযার ইবনে মাখরামা ও আবদুর রহমান ইবনে আবদ আসওয়াদ ইয়াগুসের সাথে এ ব্যাপারে সাক্ষাৎ করেন। তিনি তাদেররকে বলেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহর শপথ করে বলছি তোমার আমাকে হযরত আয়েশা (রা) -এর কাছে নিয়ে চল। কেননা, তার জন্য এটা বৈধ নয় আমার সাথে আত্মীয়তার সর্ম্পক ছিন্ন করার মাধ্যেমে শপথ করে বসে থাকবেন। মিসওয়ার ও আবদুর রহমান তাকে (চাদরে মধ্যে লুকিয়ে) আয়েশার গৃহে গেলেন। তাঁরা আয়েশার কাছে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি চেয়ে বললেন, “আসসালামু আলাইকা ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু” আমরা কি ভিতরে আসতে পারি? হযরত আয়েশা (রা) বললেন, আসুন। তাঁরা বললেন, আমরা সকলে কি আসব? তিনি বললেন, হ্যাঁ সকলেই আসুন। তিনি জানতেন না, তাদের সাথে আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরও রয়েছেন। তাঁর ভেতরে গেলে আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা) ভেতরে হযরত আয়েশা (রা)-এর কাছে চলে গেলেন এবং তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে শপথ করে ক্রন্দন করতে লাগলেন। মিসওয়ার এবং আবদুর রহমানও তাঁকে শপথ দিয়ে তাঁর সাথে কথা বলতে অনুরোধ করেন এবং তাঁর ত্রুটি ক্ষমা করে দিত বললেন। তাঁরা বললেন, আপনার জানা আছে, নবী করীম (স) আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করতে নিষেধ করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, “কোন মুসলমান ভাইয়ের জন্য তার মুসলমান ভাইয়ের সাথে তিন দিনের অধিক সালাম কালাম বন্ধ রাখা বৈধ নয়।” যখন তাঁরা উভয়ে আয়েশাকে বারবার আত্মীয়তার পবিত্র বন্ধনের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন এবং পীড়াপীড়ি করছিলেন, তখন তিনিও তাঁদেরকে আত্মীয়তার বন্ধনের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে লাগলেন এবং কাঁদতে লাগলেন। তিনি বলেন, আমি শক্ত মানত করেছি। কিন্তু তাঁরা উভয়ে তাঁকে অনুরোধ করতে থাকলেন। পরিশেষে তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের সাথে কথাবার্তা বললেন। তিনি তাঁর এই শপথ ভঙ্গের জন্য চল্লিশটি ক্রীতদাসকে আযাদ করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি মানতের কথা মনে করে এত কাঁদতেন যে, তাঁর ওড়না চোখের পানিতে ভিজে যেত। (বুখারী)


১৮৬২. হযরত ওকবা ইবনে আমের (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) উহুদের যুদ্ধের শহীদানদের কবর যিয়ারত করতে গেলেন। তিনি আট বছর পর তাঁদের জন্য এমনভাবে দোয়া করেন যেমন জীবিত ব্যক্তিরা মৃতকে দাফন করে প্রস্থান করে। এরপর তিনি এসে মিম্বরে উঠে বললেন, আমি তোমাদের অগ্রবর্তী আমি তোমাদের পক্ষে সাক্ষী হব এবং তোমাদের সাথে প্রতিশ্রুতি থাকল ‘কাউসার’ নামক ঝর্ণাধারায় পাশে তোমাদের সাথে আবার সাক্ষাৎ হবে। আমি এখন এখান হতে তা দেখতে পারছি। আমি তোমাদের ব্যাপারে এ আশঙ্কা করি না যে, তোমরা পুনরায় শিরকে রত হবে। বরং আমার ভয় হচ্ছে তোমরা পৃথিবীর ভোগ-লালসায় রত হয়ে পড়বে। ওকবা ইবনে আমের (রা) বলেন, আমি এ সময়ই শেষ বারের মতো রাসূলুল্লাহ (স) -কে দেখেছিলাম।  (বুখারী ও মুসলিম)

অপর বর্ণনায় আছে, তিনি বলেছেন, আমার ভয় হচ্ছে যে, তোমরা পার্থিব জগতের ভোগ-বিলাসিতায় লিপ্ত হয়ে পড়বে এবং পরস্পর হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে তোমাদের পূর্ব কালের লোকদের মত ধ্বংস হয়ে যাবে। ওকবা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (স)-কে মিম্বরের উপর এটাই আমার সর্বশেষ দেখা।

অন্য এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, আমি তোমাদের অগ্রবর্তী। আমি তোমাদের পক্ষে সাক্ষী। আল্লাহর শপথ! আমি এ মুহূর্তে আমার হাউযে কাওসার দেখতে পাচ্ছি। আমাকে সঞ্চিত ধনরাশির চাবি দান করা হয়েছিল অথবা প্রিথিবির চাবি দেয়া হয়েছিল। আল্লাহর শপথ! আমি নিশ্চয়ই তোমাদের ব্যাপারে আমার অনুপস্থিতিতে শিরকে লিপ্ত হবার আশঙ্কা করিনি। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে, তোমরা দুনিয়ার লোভ-লালসায় জড়িয়ে পড়বে। ইমাম নববী (র) বলেন, এ হাদীসে উল্লিখিত উহুদ যুদ্ধের শহীদদের জন্য নামাযের অর্থ হলো দুআ।


১৮৬৩. হযরত আবু যায়েদ আমর ইবনে আখতাব আল আনসারী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (স) আমাদরেকে ফযরের সালাত পড়ালেন। এরপর মিম্বরে উঠে আমাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করেন। এভাবে যোহরের সময় হয়ে গেল। মিম্বর হতে নেমে তিনি আসরের নামায কায়েম করলেন। পুনরায় তিনি মিম্বরে উঠে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বক্তৃতা করেন। বিশ্বে যা কিছু ঘটে গেছে এবং যা কিছু ঘটবে এ সম্পর্কে তিনি আমাদেরকে অবহিত করেন। আমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা জ্ঞানী ব্যক্তি এসব সুন্দরভাবে হেফাজত করতে সক্ষম হয়েছেন । (মুসলিম)


১৮৬৪. হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্য করার জন্য মানত করল সে যেন তা পরিপূর্ণ করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্যতা করার জন্য মানত করল সে যেন তা পূর্ণ না করে।” (বুখারী)


১৮৬৫. হযরত উম্মে শারীক (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) তাকে গিরগিটি হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, “গিরগিটি ইবরাহীমের (আ) আগুনের ফু দিয়েছিল।” ( বুখারী ও মুসলিম)


১৮৬৬. হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি প্রথম আঘাতে গিরগিটিকে হত্যা করতে পারল তার জন্য এত এত অধিক পুণ্য রয়েছে। যে ব্যক্তি দ্বিতীয় আঘাত কতল করতে পারল তার জন্য এত এত পুণ্য রয়েছে; তবে প্রথমটির সমান নয়। যে ব্যক্তি তৃতীয় আঘাতে হত্যা করতে পারল তার জন্যও পুণ্য রয়েছে। অপর এক বর্ণনা রয়েছে, যে ব্যক্তি প্রথম আঘাতেও গিরগিটিটিকে হত্যা করতে পারল, তার জন্য নেকী লেখা হয় একশত পুণ্য। দ্বিতীয় আঘাতে তার চেয়ে কম এবং তৃতীয় আঘাতে দ্বিতীয় বারের চেয়েও কম পুণ্য হবে। (মুসলিম)


১৮৬৭. হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, এক ব্যক্তি বলল, আমি আজ সদকা করব। সে তার সদকা নিয়ে বের হল এবং চোরের হাতে দিয়ে আসল। এতে লোকজন বলাবলি করতে লাগল, গত রাতে চোরকে সদকা দেয়া হয়েছে। সদকা প্রদানকারী বলল, হে আল্লাহ! সকল প্রশংসা তোমার জন্য, আজ আমি সদকা দিব। দ্বিতীয় দিনেও সে সদকার অর্থ নিয়ে বের হল এবং এক ব্যভিচারিণীর হাতে দিয়ে আসল। লোকেরা বলাবলি করতে লাগল, গত রাতে এক যিনকারিণীকে সদকা বস্তু দেয়া হয়েছে। সদকা প্রদানকারী বলল, হে আল্লাহ! এ ব্যভিচারিণীর জন্য তোমার শোকর আদায় করছি। আমি অবশ্যই আরো সদকা করব। তৃতীয় রাতে সে সদকা নিয়ে বের হল এবং ধনী ব্যক্তিকে দিয়ে আসল। সকাল বেলা লোকেরা বলাবলি করতে লাগল, গত রাতে এক ধনী ব্যক্তি সদকা পেয়েছে। সদকা প্রদানকারী বলল, হে আল্লাহ! তোমার জন্য সকল প্রশংসা। তুমি আমার সদকা চোরকে চোর, ব্যভিচারিণী ও ধনী ব্যক্তিকে দেয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। অতএব ঐ ব্যক্তিকে বলা হল, তুমি চোরকে সদকা দিয়েছ সম্ভবত চুরি হতে বিরত থাকবে। তুমি যিনাকারিণীকে সদকা দিয়েছে, সম্ভবত সে তার কুর্কম হতে বিরত রবে। আর ধনী ব্যক্তিকে সদকা দিয়েছ, আশা করা যায় সে এটা হতে নসিহত গ্রহণ করবে এবং আল্লাহ তাকে যে ধন-সম্পদ দিয়েছেন তা ব্যয় করবে। ইমাম বুখারী (র) উল্লিখিত ভাষায় এবং ইমাম মুসলিম (র) সমার্থবোধক ভাষায় হাদীসটি বর্ণানা করেছেন।


১৮৬৮. হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বললেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (স) -এর সাথে কোন এক খানার সমাবেশে দাওয়াতে গিয়েলিাম। তাঁর সামনে একখানা রান পরিবেশন করা হল। তিনি রানের গোশত অধিক পছন্দ করতেন। তিনি রান হতে দাত দিয়ে গোশত ছিঁড়ে নিয়ে বললেন, আমি কেয়ামতের দিন সমগ্র মানবজাতির নেতা হব। তোমরা কি জান কেন হব? কেয়ামতের দিন মহান আল্লাহ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল মানবকে এক সমতল ভূমিতে একত্রিত করবেন। দর্শকরা তা দেখেতে পাবে এবং আহবানকারীর আহ্বানও তারা শুনতে পাবে। সূর্য তাদের কাছাকছি হবে। এ সময় লোকজন অসহনীয় ও অসহ্য দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হবে। লোকজন পরস্পরকে বলবে, তোমরা কি দেখছ না তোমাদের কি অবস্থা হয়েছে এবং তোমাদের দুঃখ-দুশ্চিন্তা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে? কেন তোমরা এমন ব্যক্তির অনুসন্ধান করছ না যিনি তোমাদের রবের কাছে তোমাদের জন্য সুপারিশ করতে পারবেন? লোকেরা তখন একে অন্যকে বলবে, তোমাদের সকলের আদি পিতা তো হযরত আদম (আ) ।   তাই তারা তাঁর কাছে গিয়ে বলবে, হে আদম (আ)! আপনি সমগ্র মানবকুলের পিতা। আল্লাহ আপনাকে নিজের হাতে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি আপনার মধ্যে তাঁর রূহ ফুঁকে দিয়েছেন। ফেরেশতাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, তাই তাঁরা আপনাকে সেজদা করেছে। আর তিনি আপনাকে বেহেশতে বসবাস করতে দিয়েছেন। আপনি কি আপনার রবের কাছে আমাদের জন্য সুপারিশ করবেন না? আপনি কি দেখেছেন না আমাদের কি অবস্থা হচ্ছে এবং আমাদরে দুঃখ-দুর্দশা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে? হযরত আদম (আ) বলবেন, আমার রব আজকের দিনে ক্রোধান্বিত হয়েছেন যা ইতোপূর্বে কখনো তিনি হননি এবং পরেও কখনো হবেন না। তিনি আমাকে একটি বৃক্ষের কাছে যেতে নিষেধ করছিলেন। কিন্তু আমি সে আদেশ অমান্য করেছি। হায় আমার কি হবে! হায় আমার কি হবে! তোমরা অপর কারো কাছে যাও। তোমরা বরং নূহের কাছে যাও। তাই তারা হযরত নূহের (আ) -এর কাছে ছুটে গিয়ে বলবে, হে নূহ (আ)! আপনি পৃথিবীবাসীর জন্য সর্বপ্রথম রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন। আল্লাহ আপনাকে কৃতজ্ঞ বান্দা উপাধি দিয়েছেন। আপনি কি আমাদের অবস্থা দেখছেন না? আপনি কি দেখছেন না, আমাদের দুর্দশা কি চরম পরিসীমায় পৌঁছে গিয়েছে? আপনি কি আমাদের জন্য আপনার রবের কাছে সুপারিশ করবেন না? তিনি বলবেন, আজ আমার রব এত ক্রোধান্বিত যে ইতোপূর্বে কখনো এরূপ ক্রোধান্বিত হননি এবং এরপর কখনো হবেন না। আমার একটি দোয়া করার অধিকার ছিল। আমি আমার কওমের পক্ষে সে দোয়া করেছি। ফলে তারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। হায় আমার কি হবে! হায় আমার কি হবে! তোমরা অন্য কারো কাছে যাও। তোমরা বরং ইবরাহীমের কাছে যাও। তারা হযরত ইবরাহীমের কাছে গিয়ে বলবে, হে ইবরাহীম (আ)! আপনি আল্লাহর নবী! পৃথিবীবাসীর মধ্যে আপনিই তাঁর খলিল তথা প্রিয় বন্ধু। আপনার রবের কাছে আমাদের সুপারিশ করুন। আমাদের কি অবস্থা দেখছেন না? তিনি তাদেরকে বলবেন, আমার প্রভু আজকে এত ক্রোধিন্বিত যে ইতোপূর্বে তিনি কোন দিন এরূপ ক্রোধান্বিত হননি এবং পরেও কখনো হবেন না। আমি তিনটি মিথ্যা বলেছিলাম। (তাই আমি লজ্জিত) আমার কি হবে! আমার কি হবে! আমার কি হবে! তোমরা অন্য কারো কাছে যাও। তোমরা মূসার কাছে যাও। তখন লোকজন হযরত মূসার (আ) –এর কাছে বলবে, হে মূসা (আ) ! আপনি আল্লাহর রাসূল! মানবজাতির মধ্যে আপনাকে আল্লাহ তাঁর রিসালাত ও তাঁর সাথে কথা বলার অবকাশ দিয়ে সম্মানিত করেছেন। আপনি আমাদের মুক্তির জন্য আপনার রবের কাছে সুপারিশ করুন। আপনি কি দেখছেন না আমরা কি দুর্দশার মধ্যে পড়ে আছি? তিনি বলবেন, আজ আমার রব এত ক্রোধান্বিত হয়েছেন যে ইতোপূর্বে তিনি আর কখনো এত ক্রোধান্বিত হননি এবং পরেও আর কখনো হবেন না। তাছাড়া আমি একটি ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলাম। অথচ তাকে হত্যা করার আদেশ আমার জন্য ছিল না। হায় আমার কি হবে! হায় আমার কি হবে! তোমরা বরং অন্য কারো কাছে যাও। তোমরা ঈসার কাছে যাও। তাই সবাই হযরত ঈসা (স) -এর কাছে গিয়ে বলবে হে ঈসা (আ) ! আপনি আল্লাহর রাসূল এবং তার কালেমা যা তিনি মরিয়ামকে দিয়েছিলেন। আর আপনি রুহুল্লাহ (তাঁর দেয়া রূহ) ।   আপনি দোলনায় থাকতে (শৈশবেই) মানবের সাথে কথা বলেছেন। আপনি আমাদের জন্য আপনার রবের কাছে সুপারিশ করুন। আপনি কি দেখছেন না আমরা কি দুর্গতির মধ্যে পড়ে রয়েছি? হযরত ঈসা (আ) বলবেন, আমার রব আজ ভীষণ ক্রোধান্বিত। ইতোপূর্বে তিনি কখনো এরূপ ক্রোধান্বিত হননি, আর না পরেও কখনো হবেন। হযরত ঈসা (আ) তাঁর কোন পাপের কথা উল্লেখ করবেন না। হায়, আমার কি হবে! হায়, আমার কি হবে! হায়, আমার কি হবে! তোমরা বরং অন্য কারো কাছে যাও। হ্যাঁ, তোমরা মুহাম্মদ (স) -এর কাছে যাও।

অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেন, তারা আমার কাছে এসে বলবে, হে মুহাম্মদ! আপনি আল্লাহর রাসূল ও সর্বশেষ নবী; আল্লাহ আপনার পূর্বাপর সব ক্রটিবিচ্যুতি মাফ করে দিয়েছেন। আপনি আমাদের জন্য আপনার রবের কাছে সুপারিশ করুন। আপনি কি জানেন না, আমরা কিরূপ বিপদের মধ্যে রয়েছি? রাসূলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন, আমি সামনে অগ্রসর হয়ে মহান আরশের নিচে যাব এবং আমার মহামহিম রবের সামনে সিজদায় পড়ে যাব। মহান আল্লাহ আমাকে তাঁর প্রশংসা স্তুতি শিক্ষা দিবেন। আমার পূর্বে আর কাউকে ঐ প্রশংসা গাঁথা শিক্ষা দেননি। এরপর বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! তুমি মাথা উঠাও, তুমি যা চাইবে তা দেয়া হবে, সুপারিশ করলে তা কবুল করা হবে। এরপর আমি মাথা তুলে বলব, হে রব! আমার উম্মাত! হে রব আমার উম্মাত! (অর্থাৎ আমার উম্মাতের কি হবে?) তখন বলা হবে, হে মুহাম্মাদ! তোমার উম্মতের যে সব লোকের হিসাব নেয়া হবে না (বিনা হিসেবে বেহেশতে গমনের সুযোগ পাবে) তাদেরকে বেহেশতের ডান দিকে দিকের দরজা দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দাও। অন্য সব বেহেশতীদের সাথে তারা বেহেশতের অন্যান্য দরজা দিয়েও যেতে পারবে। এরপর তিনি বলেন, সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার যান। বেহেশতের প্রতিটি দরজা উভয় পাল্লার মাঝখানে এতখানি স্থান থাকবে যতখানি দূরত্ব মক্কা এবং হাজর নামক স্থানের দূরত্ব। অথবা (বর্ণনাকারীর সন্দেহ) তিনি বলেন, যতখানি দূরত্ব মক্কা এবং বসরার মধ্যে। (বুখারী ও মুসলিম)


১৮৬৯. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইবরাহীম (আ) ইসমাঈলের মা ও তাঁর দুগ্ধপোষ্য শিশুকে (ইসমাঈল) নিয়ে আসলেন। তাঁদেরকে তিনি একটি প্রকাণ্ড গাছের নিচে, মসজিদের উচ্চ ভূমিতে যমযমের স্থানে রাখলেন। সে সময় কোন জন বসতি কিংবা পানির ব্যবস্থও ছিল না। তিনি তাঁদেরকে সেখানে রাখলেন। এরপর ইবরাহিম! (আ) সেখান হতে রওয়ান হলেন। ইসমাঈলের মা তাঁর পেছনে পেছনে যাচ্ছিলেন এবং বললেন, হে ইবরাহিম (আ)! আপনি আমাদেরকে এ জনপ্রাণীহীন উপত্যকায় রেখে কোথায় যাচ্ছেন? এখানে তো বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিতি পরিবেশ কিছুই নেই। তিনি তাঁকে একথা বারবার বলতে থাকলেন। কিন্তু ইবরাহীম তাঁর কথার কোন ভ্রুক্ষেপ করলেন না। তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করেন, আল্লাহ কি আপনাকে এটা করার নির্দেশ দিয়েছেন? ইবরাহীম (আ) বললেন, হ্যাঁ! তখন ইসমাঈলের মা বলেন, তবে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না। এরপর তিনি স্বস্থানে ফিরে আসলেন। হযরত ইবরাহীম (আ) বিদায় হলেন। তিনি তাঁদের দৃষ্টি সীমার বাইরে সানিয়াহ নামক স্থানে পৌঁছে কা’বা গৃহের দিকে মুখ ফিরালেন। দু’হাত তুলে এই বলে দোয়া করেন, হে আমাদের প্রতিপালক! আমি পানি ও তরুলতা শূন্য উষর এক প্রান্তরে আমার সন্তানদের একটি অংশ তোমার মহাসম্মানিত গৃহের কাছে এনে বসবাসের জন্য রেখে গেলাম। “হে আমার রব! এটা আমি এজন্য করেছি যে, তারা যেন এখানে নামায কায়েম করতে পারে। সুতরাং তুমি লোকদের অন্তরকে এদের প্রতি অনুরক্ত করে দাও। ফলমূল হতে এদেরকে খাবার দান কর। যেন তারা কৃতজ্ঞতা আদায়কারী বান্দা হতে পারে।” (সূরা ইবরাহীম, ৩৭)।   ইসমাঈলের মা ইসমাঈলকে বুকের দুধ দিয়ে লালন-পালন করতে লাগলেন। তিনি নিজে মশকের পানি পান করতে থাকলেন। পরিশেষে, যখন মশকের পানি শেষ হয়ে গেল, তিনি নিজে এবং তার সন্তান পিপাসায় কাতর হয়ে পড়লেন। তিনি দেখলেন, তার দুগ্ধপোষ্য শিশু তৃষ্ণায় ছটফট করছে। তিনি তা সহ্য করতে না পেরে সাফা পাহাড়ে উঠে চারদিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করেন। উপত্যকার দিকে এই আশায় তাকালেন যে, কারো দেখা যায় কিনা। কিন্তু কারো দেখা পেলেন না। তাই তিনি সাফা পাহাড় হতে নেমে আসলেন এবং উপত্যকা পেরিয়ে মারওয়া পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছে তাতে আরোহণ করেন। পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে তিনি একটি-সেদিক তাকিয়ে দেখলেন কাউকে দেখা যায় না কিনা। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। এমনিভাবে তিনি দুই পাহাড়ের মাঝখানে সাতবার দৌঁড়ালেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (স) বলেছেন, এ কারণেই লোকজন (হজ্বের সময়) উভয় পাহাড়ের মধ্যে দৌঁড়ে (সাঈ করে) থাকে। ইসমাঈলের মা যখন শেষবারের মতো দৌঁড়ে মারওয়া পাহাড়ে উঠলেন, তখন একটা আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি নিজেকে লক্ষ্য করে বললেন, কি ব্যাপার আওয়াজ শুনতে পেলাম যেন। এরপর তিনি শব্দের প্রতি কান খাড়া করেন। তিনি আবার শব্দ শুনতে পেলেন এবং মনে মনে বলেন, হঠাৎ তিনি (র্বতমান) যমযমের কাছে একজন ফেরেশতাকে দেখতে পেলেন। সে তাঁর পায়ের গোড়ালী দিয়ে মৃত্তিকা খুঁড়ছিল এবং এভাবে পানি ফুটে বের হল। তিনি এর চারপাশে বাধঁ দিলেন এবং অঞ্জলি ভরে মশকে পানি ভরতে লাগলেন। তিনি তো মশকে পানি ভরছিলেন অথচ এদিকে উথলিয়ে পড়তে থাকল। অপর বর্ণনায় রয়েছে, তিনি মশক ভরে পানি রাখলেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণনা করেন, নবী করীম ইরশাদ করেছেন, ইসমাঈলের মায়ের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। যদি তিনি যমযমকে ঐ অবস্থায় রেখে দিতেন অথবা তিনি বলেন, তা হতে যদি মশক ভরে তিনি পানি না রাখতেন তবে যমযম একটি প্রবহমান ঝর্ণায় পরিণত হতো। নবী করীম (স) বলেন, তিনি পানি পান করেন এবং তাঁর সন্তানদের দুধ পান করালেন। ফেরেশতারা তাঁকে বললেন, আপনি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ভয় করবেন না। কেননা, এখানে আল্লাহর গৃহের স্থান সুনির্দিষ্ট রয়েছে। যা এই ছেলে ও তাঁর পিতা নির্মাণ করবেন। আল্লাহ এখানকার বাসিন্দাদেরকে ধ্বংস করবেন না। এসময়ে বাইতুল্লাহর স্থানটি ভূমি হতে কিছুটা উঁচু অর্থাৎ টিলার মতো ছিল। বন্যা প্লাবন আসলে এর ডান ও বাম দিক দিয়ে প্রবাহিত হতো। মা ও সন্তানের কিছু কাল এভাবে অতিবাহিত হওয়ার পর ঘটনাক্রমে বনী জুরহুমের কাফেলা অথবা বনী জুরহাম গোত্রের লোক এ পথ দিয়ে ‘কাদা’ নামক স্থান হতে আসছিল। তারা মক্কার নিম্ন ভূমিতে এসে পৌঁছলে সেখানে কিছু পাখি বৃত্তাকারে উড়তে দেখে তারা বলল, এসব পাখি নিশ্চয়ই পানির উপর চক্কর খাচ্ছে। আমরা তো এই মরুভূমিতে এসেছি অনেক দিন হল! কিন্তু কোথাও পানি দেখিনি। তারা একজন অথবা দু’জন অনুসন্ধানকারীকে সন্ধান নেয়ার জন্য পাঠাল। তারা গিয়ে পানি দেখতে পেল এবং ফিরে গিয়ে তাদেরকে জানাল। কাফেলার লোকেরা অনতিবিলম্বে পানির দিকে চলে আসল। ইমাঈলের মা তখন পানির কাছে বসে ছিলেন। তারা এসে তাঁকে বলল, আপনি কি আমাদেরকে এখানে এসে অবস্থান করার অনুমতি দেবেন? তিনি বললেন হ্যাঁ! কিন্তু পানির উপর তোমাদের কোন মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে না। তারা বলল, হ্যাঁ! তাই হবে। আবদুল্লাহ ইবেন আব্বাস (রা) বর্ণনা করেন। নবী করীম ইরশাদ করেছেন, ইসমাঈলের মায়ের উদ্দেশ্য ছিল তাদের সাথে পরিচিত হয়ে একটি অন্তরঙ্গ ও সহানুভূতি সম্পন্ন পরিবেশ গড়ে তোলা। ঐ সকল লোক এসে এখানে বসতি স্থাপন করল এবং কাফেলার অপরাপর ব্যক্তিও তাদের পরিবার পরিজনদেরকে ডেকে আনল। অবশেষে সেখানে যখন বেশ কয়েক ঘর বসতি গড়ে উঠলো, ইসমাঈল যৌবনে পদার্পণ করেন এবং তাদের কাছ হতে আরবী শিখে নিলেন। তার স্বাস্থ্য-চেহারা ও সুরুচি পূর্ণ জীবন তারা অধিক পছন্দ করেন। তিনি বড় হলে এ ব্যক্তিরা তাদের এক মহিলার সাথে তাঁর বিয়ে দিলেন। ইতোমধ্যে ইসমাঈলের মা ইন্তেকাল করেন। হযরত ইসমাঈলের বিয়ের পর হযরত ইবরাহিম মক্কায় এলেন। তিনি নিজের রেখে যাওয়া বস্তু খোঁজ করতে লাগলেন। তিনি ইসমাঈলকে বাড়িতে পেলেন না। তিনি পুত্রবধূর কাছে জিজ্ঞেস করেন, ইসমাঈল কোথায় গেছে। সে বলল, খাদ্যের সংস্থান করার জন্য বাইরে গেছেন। অন্য বর্ণনায় আছে, তিনি শিকারে বের হয়েছেন। হযরত ইবরাহিম (আ) তাঁদের জীবনযাত্রা ও পরিবারিক বিষাদির খোঁজ নিলেন। পুত্রবধূ বলল, আমরা খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছি। দুঃখ-যাতনা আমাদেরকে ঘিরে ধরেছে। এসব কথা বলে সে অভিযোগ করল। তিনি বলেন, তোমার স্বামী আসলে তাঁকে সালাম বলবে, সে যেন তাঁর গৃহের দরজার চৌকাঠ বদল করে। গৃহে ফিরে হযরত ইসমাঈল কিছু অনুভব করতে লাগলেন। তিনি স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, কেউ ভিতরে এসেছিলেন নাকি? স্ত্রী বলল, হ্যাঁ, এরূপ একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি এসেছিলেন। তিনি আপনার সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমি তাঁকে অবহিত করলাম। আমাদের জীবন যাত্রা কিরূপ চলছে তিনি তাও জিজ্ঞেস করেন। আমি তাঁকে জানালাম যে, আমরা খুব কষ্ট-ক্লেশের মধ্যে দিনাপাতি করছি। হযরত ইসমাঈল (আ) জিজ্ঞেস করেন, তিনি তোমাকে কোন কথা বলে গিয়েছেন? স্ত্রী বলল, হ্যাঁ। তিনি আপনাকে সালাম পৌঁছতে বললেন, তিনি আপনাকে ঘরের চৌকাঠ বদল করতে বলেছেন। হযরত ইসমাঈল (আ) বললেন, তিনি আমার পিতা! তিনি তোমাকে পরিত্যাগ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের কাছে চলে যাও। পরে তিনি তাকে তালাক দিলেন এবং ঐ গোত্রের অন্য একজন মহিলাকে বিয়ে করেন। আল্লাহর ইচ্ছায় হযরত ইবরাহিম অনেক দিন আর এদিকে আসেননি। পরে তিনি যখন আবার আসলেন তখনও ইমাইঈলের সাথে সাক্ষাৎ হলো না। পুত্রবধূর কাছে গিয়ে ইসমাঈলের কথা জিজ্ঞেস করলে সে বলল, আমাদের খাদ্যের সন্ধানে গিয়েছেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কেমন রয়েছ? তিনি তাদের পরিবারিক জীবন ও অপরাপর বিষয়ও জানতে চাইলেন। উত্তরে ইসমাঈলের স্ত্রী বলেন, আমরা খুব ভাল এবং সচ্ছল অবস্থায় দিনযাপন করছি। একথা বলে সে মহান আল্লাহর প্রশংসা করল। হযরত ইবরাহীম (আ) জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কি ভক্ষণ কর? পুত্রবধূ বলল, গোশত। তিনি জিজ্ঞেস করেন, কি পান কর? সে বলল, পানি। তখন ইব্রাহীম (আ) এ দোয়া করেন, হে আল্লাহ! এদের গোশত ও পানিতে রবকত দিন। নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেন, সে সময় তাদের কাছে কোন খাদ্যশস্য ছিল না। যদি থাকত তবে হযরত ইবরাহীম (আ) তাদের খাদ্যশস্যের রবকতের দোয়া করতেন। এজন্যই মক্কা ছাড়া অন্য কোথাও শুধু গোশত আর পানির উপর নির্ভর করে জীবন-যাপন করত দেখা যায় না। তবে কারো রুচি বা দৈহিক অবস্থার অনুকূল না তাহলে ভিন্ন কথা। অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে, তিনি এসে জিজ্ঞেস করেন, ইসমাঈল কোথায়? তাঁর স্ত্রী বলল, তিনি শিকারে গিয়েছেন। আপনি আসুন, কিছু পানাহার করুন। তিনি জিজ্ঞেস করেন, তোমাদের খাদ্য পানীয়ের ব্যবস্থা কি? পুত্রবধূ বলল, আমারা গোশত ভক্ষণ করি এবং পানি পান করি। তিনি বলেন, হে আল্লাহ! তাদের খাদ্য-পানিতে বরকত দিন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণনা করেন, আবুল কাসেম (স) ওয়া সাল্লাম বললেন, ইবরাহিম (আ) -এর দোয়ার বরকতেই মক্কাবাসীদের খাদ্য পানীয়তে বরকত হয়েছে। হযরত ইবরাহীম (স) বলেন, তোমার স্বামী ফিরে আসলে তাঁকে আমার সালাম জানিয়ে বলবে সে যেন তাঁর গৃহের চৌকাঠ সংরক্ষন করে। হযরত ইসমাইল (আ) ফিরে এসে স্ত্রী জিজ্ঞেস করেন, তোমার কাছে কেউ কি এসেছিল? স্ত্রী বলল, হ্যাঁ, আমার কাছে একজন সুন্দর সুঠাম বৃদ্ধ ব্যক্তি এসেছিলেন। স্ত্রী বৃদ্ধের কিছু প্রশংসা করল। তিনি জিজ্ঞেস করেন, কিভাবে আমাদের জীবিকা ও ভরণপোষণ চলছে? বললাম, আমরা বেশ ভালো আছি। হযরত ইসমাঈল (আ) জিজ্ঞেস করেন, তিনি কি তোমাকে কোন উপদেশ দিয়েছেন? স্ত্রী বলল, হ্যাঁ, তিনি আপনাকে সালাম জানিয়েছেন এবং গৃহের চৌকাঠ সংরক্ষন করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। সব কথা ইসমাঈল বললেন! তিনি আমার পিতা আর তুমি হলে ঘরের চৌকাঠ। তিনি আমাকে তোমার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখার আদেশ দিয়ে গিয়েছেন। হযরত ইবরাহীম (আ) আল্লাহর ইচ্ছায় অনেক দিন পর্যন্ত আর আসেননি। এরপর একদিন ইসমাঈল (আ) যমযম কূপের পাশে একটি বিরাট বৃক্ষের নিচে বসে তার তীর ঠিক করছিলেন। এমন সময় হযরত ইবরাহীম (আ) আসলেন! হযরত ইসমাঈল (আ) পিতাকে দেখে উঠে অগ্রসর হলেন। এরপর যেরূপে পিতা পুত্রের সাথে এবং পিতার সাথে সৌজন্য বিনিময় করে থাকে তারাও তাই করেন। তিনি বললেন হে ইসমাঈল! আল্লাহ আমাকে একটি কাজের নির্দেশ দিয়েছেন। হযরত ইসমাঈল (আ) বললেন, আমার রব আপনাকে যে কাজের আদেশ করেছেন তা আঞ্জাম দিন। তিনি বললেন, তুমি আমাকে এ কাজে সাহায্য কর । পুত্র বললেন, হ্যাঁ, আমি আপনাকে অবশ্যই সাহায্য করব। হযরত ইবরাহীম (আ) বললেন, আল্লাহ আমাকে এখানে একখানা গৃহ নির্মাণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। একথা বলে তিনি একটি উঁচু তিলার দিকে ইশারা করে বললেন, এর চারদিকে গৃহ নির্মাণ করতে হবে। এরপর তারা এ গৃহের ভিত্তি স্থাপন করেন। হযরত ইসমাঈল (আ) পাথর বয়ে আনতেন আর হযরত ইবরাহিম (আ) তা দিয়ে ভিত গাথঁতেন। চতুর্দিকের প্রাচীর অনেকটা উঁচু হয়ে গেলে ইবরাহীম (আ) পাথরটি এনে (মাকানে ইবরাহীম) এর উপর দাঁড়িয়ে ভিত গাথঁতে লাগলেন আর ইসমাঈল (আ) পাথর এনে যোগান দিতে থাকলেন। পিতাপুত্র উভয়ে গৃহ নির্মান করার সময় দোয়া করতে থাকলেন, “হে আমাদের রব! আমাদের এই প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম গ্রহণ করুন।”  (সূরা বাকারাঃ১২৭)

অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে, হযরত ইবরাহীম (আ) ইসমাঈল ও তাঁর মাকে সাথে করে বেরিয়ে পড়লেন। তাদের সাথে একটি পানির মশক ছিল। ইসমাঈলের মা মশকের পানি পান করতেন এবং সন্তানকে দুধ পান করাতেন। এভাবে তারা মক্কায় পৌঁছলেন। হযরত ইবরাহীম (আ) স্ত্রীকে একটা গাছের নিচে রেখে পরিবার-পরিজনদের কাছে রওয়ানা হলেন। ইসমাঈলের মা তাঁর পেছনে পেছনে যেতে থাকলেন। অবশেষে ‘কাদা’ নামক স্থানে পৌঁছে তিনি পেছন হতে স্বামীকে ডেকে বললেন, হে ইবরাহিম! আপনি আমাদেরকে কার কাছে রেখে যাচ্ছেন? তিনি বলেন, আল্লাহর কাছে রেখে যাচ্ছি। ইসমাঈলের মা বললেন, আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এ কথা বলে তিনি ফিরে আসলেন; তিনি মশকের পানি পান করতেন এবং বাচ্চাকে দুধ পান করাতে লাগলেন। এক সময় পানি ফুরিয়ে গেল। তিনি বললেন, আমাকে কোথাও গিয়ে অনুসন্ধান করা উচিৎ কাউকে দেখা যায় কিনা। নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেন, এ বলে তিনি রওয়ানা হলেন এবং সাফা পাহাড়ে গিয়ে উঠলেন। তিনি পাহাড় হতে নেমে মারওয়া পাহাড়ের দিকে চললেন। উপত্যকার মাঝখানে পৌঁছে তিনি দৌঁড়ালেন এবং মারওয়া পাহাড়ে এসে পৌঁছলেন। এরূপ তিনি দুই পাহাড়ের মাঝে কয়েকবার চক্কর দিলেন। এরপর ভাবলেন গিয়ে দেখে আসা দরকার আমার শিশু ছেলের কি অবস্থা। তিনি চলে গেলেন। গিয়ে দেখতে পেলেন বাচ্চা মৃত্যুর জন্য কাতরাচ্ছে। এ দৃশ্য তিনি সহ্য করতে পারলেন না। তিনি ভাবলেন, আবার গিয়ে তালাশ করা উচিত কাউকে পাওয়া যায় কিনা। তাই তিনি গিয়ে সাফা পাহাড়ে উঠলেন এবং বারবার এদিক ওদিকে তাকালেন। কিন্তু কারো দেখা পেলেন না। এরূপ সাতবার পূর্ণ হলে তিনি ভাবলেন, গিয়ে দেখা দরকার বাচ্চাটি কি করছে। ইতোমধ্যে তিনি একটি আওয়াজ শুনতে পেলেন। তাই তিনি বলে উঠলেন, যদি কোন উপকার করতে পার তবে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এস। দেখা গেল হযরত জিবরাঈল (আ) সেখানে উপস্থিত। তিনি তার পায়ের গোড়ালি দিয়ে মৃত্তিকার উপর আঘাত করার ইঙ্গিত করেন। হঠাৎ করে পানি ফুটে বের হলে ইসমাঈলের মা হতভম্ব হয়ে গেলেন। তিনি পানির চার পাশে গর্ত করতে আরম্ভ করেন। (বুখারী)


১৮৭০. হযরত সাঈদ ইবনে যায়েদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ (স) কে বলতে শুনেছি। তিনি বললেন,  “ব্যাঙের ছাতা-মাসরুম ‘মান’ শ্রেণীর খাদ্যের অন্তর্ভুক্ত। আর এর পানি চোখের রোগের নিরাময়কারী।” ( বুখারী ও মুসলিম)


 

Was this article helpful?