পিতামাতার সাথে সদাচরণ এবং নিকটাত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বহাল রাখার বিবরণ

মহান আল্লাহ বলেনঃ

‘তোমরা সবাই আল্লাহর বন্দেগী করো, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না, পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করো, এবং নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম ও মিসকীনদের সাথেও সদ্ব্যবহার করো। নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, পাশাপাশি চলার সঙ্গী, পথিক ও মুসাফির এবং তোমাদের অধীনস্থ দাস-দাসীদের প্রতি অনুগ্রহ করো।’ (সূরা আন নিসাঃ ৩৬)

মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ

‘সেই আল্লাহকে ভয় করো, যাঁর দোহাই পেড়ে তোমরা পরস্পরের নিকট থেকে নিজ নিজ হক দাবী করো এবং আত্মীয়তা ও নৈকট্যের সম্পর্ক বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাকো। (সূরা আন নিসাঃ ১)

মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ

‘(বুদ্ধিমান লোক হলো তারা) যারা, আল্লাহ যেসব সম্পর্ক বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, সেগুলো বজায় রাখে’। (সূরা আর রা’দঃ ২১)

মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ

আমরা মানুষকে নিজেদের পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছি। (সূরা আনকাবূতঃ ৮)

মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ

‘তোমার প্রভু আদেশ করেছেন যে, তোমরা শুধুমাত্র তাঁরই বন্দেগী করবে এবং পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করবে। তোমাদের কাছে যদি তাদের কোন একজন কিংবা উভয়েই বৃদ্ধাবস্থায় বর্তমান থাকে, তবে তোমরা তাদেরকে ‘উহ’ পর্যন্ত বলবে না। তাদেরকে তিরস্কার করবে না; বরং তাদের সাথে অতীব মর্যাদার সাথে কথা বলবে। বিনয় ও নম্রতার সাথে তাদের সামনে নত হয়ে থাকবে। আর এ দু’আ করতে থাকবেঃ ‘প্রভু হে! এদের প্রতি রহম করো, যেমন করে শৈশবে এরা স্নেহ-বাৎসল্যের সাথে আমায় প্রতিপালন করেছেন।’ (সূরা বনী ঈসরাইলঃ ২৩-২৪)

মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ

‘আমরা মানুষকে তাদের পিতামাতার অধিকার বুঝবার জন্য নিজ থেকে তাগিদ করেছি। তার জননী (অত্যন্ত) কষ্ট ও দুর্বলতা সহ্য করে তাকে নিজ পেটে ধারণ করেছেন। এরপর তাকে একাধারে দুধ পান করিয়েছেন। অতএব, আমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকো এবং সাথে সাথে পিতা-মাতার প্রতিও।’ (সূরা লোকমানঃ ১৪)

 

৩১২. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বর্ণনা করেন, আমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলামঃ কোন্ কাজটি আল্লাহর কাছে সবচাইতে প্রিয়? তিনি বললেনঃ যথাসময়ে নামায আদায় করা। আমি আবার জিজ্ঞেস করলামঃ তারপর কোনটি? তিনি বললেনঃ মা-বাবার সাথে সদাচরণ করা। আমি আবার জিজ্ঞেস করলামঃ এরপর কোন্ কাজটি? তিনি বললেনঃ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। (বুখারী ও মুসলিম)


৩১৩. হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ কোন সন্তানই তার পিতার অবদান পরিশোধ করতে সক্ষম নয়। কিন্তু সে (সন্তান) যদি তাকে (পিতাকে) দাস অবস্থায় দেখে এবং খরিদ করে মুক্ত করে দেয় (তবে কিছুটা প্রতিদান আদায় হতে পারে)। (মুসলিম)


৩১৪. হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের (পরকালের) প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন তার অতিথিকে সম্মান করে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতে (পরকালের) প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বহাল রাখে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে নতুবা চুপ থাকে। (বুখারী ও মুসলিম)


৩১৫. হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির কাজ শেষ করে যখন ক্ষান্ত হলেন, তখন ‘রাহেম’ (আত্নীয়তার সম্পর্ক) দাঁড়িয়ে বললোঃ এ জায়গাটি কি সেই ব্যক্তির জন্য যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা থেকে বাঁচার জন্য আপনার কাছে আশ্রয় চায়? তিনি (আল্লাহ) বললেনঃ ‘হ্যাঁ’।   তুমি কি একথায় সন্তুষ্ট হবে, যে তোমায় বজায় রাখবে, আমিও তার প্রতি দয়া করবো এবং যে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে আমিও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবো? ‘রাহেম’ বললঃ ‘হ্যাঁ, আমি সন্তুষ্ট হব।’ আল্লাহ বললেনঃ এ জয়গাটি তোমার। এরপর রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (সাহাবীদের) বললেনঃ যদি তোমরা (অবিচল) থাকতে চাও, তবে এই আয়াত পাঠ করোঃ অবশ্য ক্ষমতায় আরোহন করলে হয়ত তোমরা দুনিয়ায় চরম অশান্তি ও ফিতনার সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে? (মূলত) এরা এমন লোক যাদের ওপর আল্লাহ লা’নত বর্ষণ করেছেন এবং তাদেরকে অন্ধ ও বধির করে দিয়েছেন। (সূরা মুহাম্মদঃ ২২-২৩) (বুখারী ও মুসলিম) বুখারীর অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ মহান আল্লাহ বলেন, যে তোমায় বহাল রাখবে আমি তাকে অনুগ্রহ করবো আর যে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, আমিও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবো।


৩১৬. হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললোঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমার কাছ থেকে সদাচরণ ও সৎসঙ্গী পাওয়ার সবচেয় বেশি হকদার কে? তিনি বললেনঃ তোমার মা। সে বললঃ তারপর কে? তিনি বললেনঃ তোমার মা, সে বলল তারপর কে? তিনি বললেনঃ তোমার মা। সে বললঃ অতপর কে? তিনি বললেনঃ তোমার বাবা। (বুখারী ও মুসলিম)

অপর এক বর্ণনায় আছেঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমার কাছ থেকে সদাচরণ ও সৎসঙ্গ পাওয়ার সবচেয়ে বেশি হকদার কে? তিনি বললেনঃ তোমার মা, অতপর তোমার মা, অতপর তোমার মা, অতপর তোমার বাবা, অতপর তোমার নিকটাত্মীয়, অতপর তোমার নিকটাত্মীয়।


৩১৭. হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণিত, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ঐ ব্যক্তির নাক ধূলি-মলিন হোক, ঐ ব্যক্তির নাক ধূলি-মলিন হোক, ঐ ব্যক্তির নাক ধূলি-মলিন হোক, যে তার পিতা-মাতার উভয়কে অথবা একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেয়েও (তাদের সেবা করে) বেহেশতে যেতে পারল না।


৩১৮. হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেনঃ এক ব্যক্তি বললো, হে আল্লাহর রাসূল! আমার কিছু আত্নীয় রয়েছে, আমি তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করি; কিন্তু তারা আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। আমি তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করি; কিন্তু তারা আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। আমি তাদের ব্যাপারে বুদ্ধিমত্তা ও সহনশীলতার সাথে কাজ করি; কিন্তু তারা সর্বক্ষেত্রেই নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেয়। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তুমি যেমন বলেছো, তেমনটি যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে তুমি যেন তাদেরকে গরম ছাই খাওয়াচ্ছো। কাজেই তুমি যতক্ষণ বর্ণিত কর্মনীতির ওপর অবিচল থাকবে, ততক্ষণ আল্লাহর সাহায্য তোমার সাথে থাকবে এবং তিনিই ওদের ক্ষতি থেকে তোমায় রক্ষা করবেন। (মুসলিম)

ইমাম নববী বলেন, আলোচ্য হাদীসে গরম ছাইকে গুনাহর সাথে তুলনা করা হয়েছে। গরম ছাই ভক্ষণকারী যেমন তীব্র কষ্ট ভোগ করে, ঠিক তেমনি গুনাহগার ব্যক্তিও দুঃখ-কষ্ট ও শাস্তি ভোগ করবে; কিন্তু নেককার ব্যক্তিকে অনুরূপ কোন তীব্র কষ্ট বা শাস্তি ভোগ করতে হবে না; বরং তাকে কষ্ট দেয়া এবং তার হক নষ্ট করার জন্য তার প্রতিপক্ষই শাস্তি ভোগ করবে।


৩১৯. হযরত আনাস (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি নিজের জীবিকা প্রশস্ত হওয়া এবং নিজের হায়াত (আয়ুষ্কাল) বৃদ্ধি হওয়া পছন্দ করে, সে যেন আত্নীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে। (বুখারী ও মুসলিম)


৩২০. হযরত আনাস (রা) বর্ণনা করেন, প্রচুর খেজুর বাগানের মালিক আবু তালহা মদীনার আনসারদের মধ্যে সবেচেয় বেশি বিত্তশালী লোক ছিলেন। তার সমগ্র সম্পদের মধ্যে ‘বাইরা হাআ’ নামক খেজুর বাগানটি তার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় ছিল। বাগানটি ছিল মসজিদে নববীর সামনের দিকে। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মধ্যে ঢুকে বাগানের মধ্যকার মিষ্টি পানি পান করতেন। এই আয়াত যখন নাযিল হলোঃ ‘তোমরা নিজেদের প্রিয় জিনিস (আল্লাহর রাহে) ব্যয় না করা পর্যন্ত কিছুতেই প্রকৃত কল্যাণের অধিকারী হতে পারবে না’ (সূরা আলে ইমরানঃ ৯২), তখন আবু তালহা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! মহিমাময় আল্লাহ আপনার ওপর নাযিল করেছেনঃ তোমাদের পছন্দনীয় জিনিস আল্লাহর রাহে ব্যয় না করা পর্যন্ত তোমরা কিছুতেই প্রকৃত কল্যাণের অধিকারী হতে পারবে না। ‘বাইরা হাআ’ নামক বাগানটি আমার সবচেয় প্রিয় সম্পদ। আমি এটা আল্লাহর রাহে দান (সাদকাহ) করে দিলাম। আমি এর বিনিময়ে আল্লাহর কাছ থেকে সওয়াব ও প্রতিদানের আশা পোষণ করি।

হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী এটাকে কাজে লাগান। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আচ্ছা এটাতো বেশ লাভজনক সম্পদ। আর তুমি যা বলেছো তাও আমি শুনেছি। এখন এটা তোমার নিকটাত্মীয়দের দান করে দেয়াই আমি সমীচীন মনে করি। আবু তালহা বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আপনি যা বললেন আমি তা-ই করবো। তারপর আবু তালহা বাগানটি তার নিকট আত্নীয় ও চাচাতো ভাইদের মাঝে বন্টন করে দিলেন। (বুখারী ও মুসলিম)


৩২১. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর বিন আস (রা) বলেন এক ব্যক্তি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললো, আমি আপনার কাছে জিহাদ ও হিজরত করার বাইয়াত গ্রহণ করতে চাই; এবং (এজন্য) আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে প্রতিদানের আশা রাখি। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমার বাপ-মায়ের কেউ কি বেঁচে আছে? সে বললঃ হ্যাঁ, তারা উভয়েই বেঁচে আছে। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এরপরও তুমি আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিদান আশা করো? লোকটি বললোঃ হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ ‘তাহলে তুমি বাপ-মায়ের কাছে ফিরে যাও; তাদের সাথে সদাচরণ করো এবং তাদের খেদমত করো। (বুখারী ও মুসলিম)

এই হাদীসের শব্দগুলো সহীহ মুসলিমের। বুখারী ও মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছে। এক লোক তাঁর নিকটে এসে জিহাদের অনুমতি চাইলে, তিনি বলেনঃ তোমার পিতা-মাতা বেঁচে আছে কি? সে বললো, হ্যাঁ! তিনি বললেনঃ তাহলে তাদের খেদমত করাকেই জিহাদ মনে করো।


৩২২. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ‘আমর (রা) বর্ণনা করেনঃ রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ সদাচরণ লাভের পরিবর্তে সদাচরণকারী আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপনকারী নয়; বরং আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপনকারী হলো সেই ব্যক্তি যার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর সে আবার তা স্থাপন করে। (বুখারী)


৩২৩. হযরত আয়েশা (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল্লাম বলেনঃ ‘রাহেম’ (আত্মীয়তার সম্পর্ক) আরশের সাথে ঝুলন্ত রয়েছে। সে (দো’আর ছলে) বলেঃ ‘যে আমায় জুড়ে দেবে, আল্লাহ তাকে জুড়ে দেবেন। যে আমায় ছিঁড়ে ফেলবে, আল্লাহ তাকে ছিঁড়ে ফেলবেন। (বুখারী ও মুসলিম)


৩২৪. উম্মুল মুমিনীন মাইমুনা বিনতে হারিস (রা) বর্ণনা করেন, তিনি একটি ক্রীতদাসীকে মুক্ত করে দিলেন। কিন্তু সেজন্য তিনি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুমতি নিলেন না। তিনি পালাক্রমে যেদিন মাইমুনার ঘরে গেলেন, সেদিন তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি জানেন? আমি আমার বাঁদীটাকে মুক্ত করে দিয়েছি?’ তিনি বললেনঃ তুমি কি তাকে মুক্তি দিয়েছো। মাইমুনা বললেনঃ‘হ্যাঁ’।   রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তুমি যদি এই বাঁদীটাকে তোমার মামাদের দিয়ে দিতে, তাহলে আরও বেশি সওয়াব অর্জন করতে। (বুখারী ও মুসলিম)


৩২৫. হযরত আসমা বিনতে আবু বকর (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় আমার মা আমার কাছে কিছু চাওয়ার জন্য মক্কা থেকে মদীনায় এলেন। তখনও পর্যন্ত তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলামঃ ‘আমার মা আমার কাছে কিছু চাওয়ার জন্য এসেছেন। আমি কি আমার মায়ের সাথে ভালো ব্যবহার করবো? রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ‘হ্যাঁ, তার সাথে ভালো ব্যবহার কর। (বুখারী ও মুসলিম)


৩২৬. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের স্ত্রী এবং সাকীফ গোত্রের কন্যা হযরত যয়নব (রা) বর্ণনা করেন, একদা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ হে মহিলা সমাজ! তোমরা সাদকা করো; এমন কি, তোমাদের গহনাপত্র দিয়ে হলেও। যয়নব বলেনঃ আমি আবদুল্লাহ ইবনে মাস’উদের (স্বামী) কাছে ফিরে এসে বললামঃ আপনি তো দরিদ্র এবং সামান্য ধন-মালের অধিকারী। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে (মহিলাদেরকে) সাদকা করার হুকুম দিয়েছেন। আপনি তাঁকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, আমার সব দান-খয়রাত আপনাকে দিলে তা সঙ্গত হবে কিনা? আবদুল্লাহ বললেনঃ তার চেয়ে বরং তুমি নিজে গিয়েই তাঁর কাছ থেকে জেনে এসো। এরপর আমি বেরিয়ে পড়লাম। আমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরজায় গিয়ে দেখি, সেখানে আরও একজন আনসার মহিলা অপেক্ষা করছে। আমাদের উভয়ের প্রসঙ্গ একই ধরনের। এ সময় রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর এক অলৌকিক অবস্থা বিরাজ করছিল।

এই সময় বিলাল আমাদের কাছে এগিয়ে এলেন। আমরা তাঁকে বললামঃ আপনি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গিয়ে খবর দিন, দু’জন মহিলা আপনার দরজায় অপেক্ষমান। তারা আপনার কাছে জানতে এসেছে, আমরা যদি আমাদের স্বামীদের এবং আমাদের প্রতিপালিত ইয়াতীমদের দান-খয়রাত করি, তবে কি তা আমাদের জন্যে সঙ্গত হবে? তবে আমরা কে, এ বিষয়ে আপনি তাঁকে কিছুই জানাবেন না। বিলাল (রা) রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে এ বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ মহিলা দু’টি কে? তিনি বললেনঃ একজন আনসার এবং একজন যয়নব। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার জিজ্ঞেস করলেনঃ এ কোন্‌ যয়নব? বিলাল (রা) বললেনঃ আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা)-এর স্ত্রী। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এদের উভয়ের জন্য দ্বিগুণ সওয়াব রয়েছেঃ (এক) নিকটাত্মীয়তার সওয়াব, (দুই) দান-খয়রাতের সওয়াব। (বুখারী ও মুসলিম)


৩২৭. হযরত আবু সুফিয়ান (রা) বর্ণনা করেন, রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস তাকে (আবু সুফিয়ানকে) জিজ্ঞেস করলঃ তিনি (অর্থ্যাৎ রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কি আদেশ করে থাকেন? আবু সুফিয়ান বলেনঃ আমি বললাম, তিনি (নবী) বলেনঃ তোমরা এক আল্লাহর বন্দেগী করো, তাঁর সঙ্গে অন্য কিছুকে শরীক করো না এবং তোমাদের পূর্ব-পুরুষরা (এ বিষয়ে) যা বলেছে, তা পরিহার করো। এ ছাড়া তিনি আমাদেরকে নামায, সত্যনিষ্ঠা, পবিত্রতা রক্ষা করা এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক বহাল রাখা ইত্যকার কাজের নির্দেশ দিয়ে থাকেন। (বুখারী ও মুসলিম)


৩২৮. হযরত আবু যার (রা) বর্ণনা করেনঃ একদা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বললেনঃ তোমরা শীঘ্রই এমন একটি অঞ্চল (জনপদ) দখল করবে, যেখানে ‘কীরাত’ (সওয়াবের একটি বিশেষ পরিভাষা) সম্পর্কে আলোচনা হয়ে থাকে। অন্য এক বর্ণনায় আছেঃ তোমরা অচিরেই মিসর জয় করবে, যেখানে কীরাতের নামোল্লেখ করা হয়। অতএব, তোমরা সেখনাকার অধিবাসীদের সাথে সদাচরণ করবে। অন্য এক বর্ণনায় আছে; এটা যখন তোমরা জয় করবে, তখন সেখানকার অধিবাসীদের প্রতি দয়াশীল হবে। কেননা তাদের মধ্যে দায়িত্বশীলতা ও আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। (মুসলিম)


৩২৯. হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেন, যখন এই আয়াত নাযিল হলো, ‘নিজের ঘনিষ্টতম আত্মীয়স্বজনকে ভয় প্রদর্শন করো’ (সূরা আশ-শুআরাঃ ২১৪) তখন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশদের ডাকলেন। তাতে সাড়া দিয়ে ছোট-বড়, উচ্চ-নীচ, ইতর-ভদ্র সবাই এক স্থানে জড়ো হলো। তিনি সবার উদ্দেশ্যে বললেনঃ ‘হে ‘আবদে শাসমের বংশধর! হে কা’ব ইবনে লুয়াইর বংশধর! নিজেদেরকে আগুনের সাজা থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করো। হে আবদে মান্নাফের বংশধর! নিজেদেরকে আগুনের সাজা থেকে বাঁচাও। হে আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর! নিজেদেরকে আগুনের সাজা থেকে বাঁচাও। আল্লাহর পাকড়াও থেকে তোমাদেরকে বাঁচানোর মালিক আমি নই। (আমার অবস্থান) শুধু এটুকুই যে, তোমাদের সাথে (আমার) আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। আমি (দুনিয়ায়) এর হক আদায়ের চেষ্টা করবো। (মুসলিম)


৩৩০. হযরত ‘আমর ইবনে আস (রা) বর্ণনা করেন, আমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে প্রকাশ্যে (গোপনে নয়) বলতে শুনেছিঃ অমুকের বংশধরগণ আমার বন্ধু বা পৃষ্ঠপোষক নয়, আমার বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষক হলেন (মহান) আল্লাহ এবং পুণ্যবান মুমিনগণ। তবে তাদের সাথে আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে, আমি তা অটুট রাখার চেষ্টা করবো। (বুখারী ও মুসলিম)


৩৩১. হযরত আবু আইয়ুব খালিদ ইবনে জায়েদ আল আনসারী (রা) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি বললঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমায় এমন একটি কাজের কথা বলুন, যা আমায় জান্নাতে প্রবেশ করাবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আল্লাহর বন্দেগী করতে থাকো, তাঁর সাথে কোন কিছু শরীক করো না, নামায কায়েম করো, যাকাত আদায় করো এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন রাখো। (বুখারী ও মুসলিম)


৩৩২. হযরত সালমান ইবনে আ’মের (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমাদের কেউ যখন ইফতার করে, সে যেন খেজুর দিয়ে ইফতার করে কারণ এতে বরকত রয়েছে। যদি খেজুর না পাওয়া যায়, তবে পানি দিয়ে ইফতার করবে। কেননা এটা পবিত্র এবং পবিত্রতা বিধানকারী। তিনি আরো বলেন, নিঃস্বকে (মিসকিনকে) দান খয়রাত করা সাদকা হিসেবে গণ্য। কিন্তু আত্মীয়-স্বজনের জন্য দু’টি বিষয় স্মর্তব্যঃ এক, দান-খয়রাত করা এবং দুই, আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখা। (তিরমিযী)


৩৩৩. হযরত ইবনে উমর (রা) বর্ণণা করেন, আমার এক স্ত্রী ছিল। আমি তাকে খুব ভালোবাসতাম। কিন্তু (পিতা) উমর তাকে পছন্দ করতেন না। একদিন তিনি আমায় বললেন, তাকে (স্ত্রীকে) তালাক দিয়ে দাও। আমি তার এই নির্দেশ অগ্রাহ্য করলাম। উমর (রা) রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিষয়টি জানালেন। এরপর রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমায় ডেকে বললেনঃ ‘স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দাও।’ (আবু দাউদ ও তিরমিযী)


৩৩৪. হযরত আবু দাররা (রা) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে বললোঃ আমার একটি স্ত্রী আছে। কিন্তু আমার মা তাকে তালাক দেওয়ার জন্য আমায় নির্দেশ দিয়েছেন। আমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ বাপ-মা জান্নাতের দরজাগুলোর মধ্যে একটি মজবুত দরজা। এখন তুমি ইচ্ছা করলে দরজাটি ভেঙ্গে ফেলতে পারো কিংবা সংরক্ষণও করতে পারো। (তিরমিযী)


৩৩৫. হযরত আবু বারাআ ইবনে আযিব বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ খালা মায়ের সমতুল্য। (মিরমিযী)

এই অনুচ্ছেদের সাথে সম্পর্কিত বহু সংখ্যক প্রামাণ্য হাদীস বিভিন্ন গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। অনুচ্ছেদটির কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় সেগুলো এখানে সংযোজন করা হলো না। এর মধ্যে ‘আমর আবনে আন্‌বাসা কতৃক বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসও রয়েছে। তার কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হলোঃ

‘আমর ইবনে আবাসা (রা) বলেনঃ নবুওয়াতের প্রথম দিকে আমি মক্কায় এসে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দেখা করলাম। আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম আপনি কে? তিনি বললেনঃ (আল্লাহর) নবী। আমি আবার প্রশ্ন করলাম নবী কাকে বলে? তিনি বললেনঃ আল্লাহ আমায় পাঠিয়েছেন। আমি আবার প্রশ্ন করলামঃ কি জিনিস নিয়ে তিনি আপনাকে পাঠিয়েছেন? তিনি বললেনঃ ‘তিনি (আল্লাহ) আমায় আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা, মূর্তি চুরমার করা, আল্লাহর একত্বের প্রতিষ্ঠা করা এবং তাঁর সঙ্গে অন্য কাউকে শরীক না করার নির্দেশসহ পাঠিয়েছেন।” (বুখারী)


 

Was this article helpful?

Related Articles