আল্লাহ্‌র জন্য ভালোবাসার গুরুত্ব, এ কর্মে অনুপ্রেরণা প্রদান, কেউ কাউকে ভালোবাসলে তাকে তা জানানোর পর সে কি বলবে তার বিবরণ

মহান আল্লাহ বলেনঃ

‘মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল! আর যারা তাঁর সঙ্গী (সাহাবী), তারা কাফিরদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর, (তবে) নিজেদের প্রতি অত্যন্ত সদয়। তুমি তাদের দেখতে পাবে আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় কখনো রুকু করছে, কখনো সিজদাবনত রয়েছে। সিজদার দরুন এসব বন্দেগীর চিহ্ন তাদের মুখাবয়বেও পরিস্ফুট হয়ে রয়েছে। তাদের (এসব) গুণাবলীর কথা তাওরাত ও ইঞ্জিলেও বিদ্যমান। তাদের দৃষ্টান্ত হলো; যেমন একটি শস্যদানা, প্রথমে সে তার অঙ্কুর বের করলো, তারপর তাকে শক্তিশালী করল, তারপর তা হৃষ্টপুষ্ট হলো। তারপর তা নিজ কাণ্ডের ওপর দাঁড়ালো। ফলে কৃষকের মনে আনন্দের সঞ্চার হলো, যেন তাদের (এই উন্নতির) দ্বারা কাফিরদের (হিংসার আগুনে) পুড়িয়ে দেয়। যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে আল্লাহ তাদের মার্জনা ও বিরাট প্রতিদানের ওয়াদা করেছেন।’ (সূরা আল-ফাতহঃ ২৯)

আল্লাহ আরো বলেনঃ

‘আর যারা দারুল ইসলামে (মদীনায়) ও ঈমানের মধ্যে তাদের (মুহাজিরদের আসার) পূর্ব থেকেই অবিচল রয়েছে, যারা তাদের কাছে হিজরত করে আসা ভালোবাসে। (সূরা আল হাশরঃ ৯)

 

৩৭৫. হযরত আনাস (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যার মধ্যে তিনটি গুণ বিদ্যমান, সে ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করেছে। (১) যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সবচেয়ে ভালোবাসে (২) যে কোন বক্তিকে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালোবাসে আর (৩) আল্লাহ যাকে কুফরীর অন্ধকার থেকে বের করেছেন, সে কুফরীর মধ্যে ফিরে যাওয়াকে আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করার মতো খারাপ মনে করে। (বুখারী ও মুসলিম)


৩৭৬. হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যেদিন আল্লাহ ছাড়া আর কারো ছায়াই থাকবে না, সেদিন সাত শ্রেণীর লোককে তিনি তাঁর সুশীতল ছায়ায় স্থান দেবেনঃ ১. ন্যায়পরায়ণ ইমাম বা নেতা ২. মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর আল্লাহর বন্দেগীতে মশগুল যুবক ৩. মসজিদের সম্পৃক্ত হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তি ৪. এমন দুই ব্যক্তি যারা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব স্থাপন করে আবার আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই বিছিন্ন হয়ে যায়। ৫. এরূপ ব্যক্তি যাকে কোন সুন্দরী নারী ব্যভিচারের প্রতি আহবান করেছে; কিন্তু সে এই বলে প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দিয়েছে যে, আমি তো আল্লাহকে ভয় করি। ৬. যে ব্যক্তি খুব গোপনে দান-খয়রাত করে, এমনকি তার ডান হাত কিছু দান করলে বাম হাতও তা জানতে পারে না এবং ৭. এমন ব্যক্তি যে নিভৃতে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং দু ’চোখের অশ্রু ঝরাতে থাকে। (বুখারী ও মুসলিম)


৩৭৭. হযরত আবু হুরাইরা (রা) বলেনঃ রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন বলবেনঃ ওহে! যারা আমার সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যে পরস্পর ভালোবাসার সম্পর্ক গড়েছিল আজ আমি তাদেরকে আমার সুশীতল ছায়াতলে স্থান দেব। আর আজ আমার ছায়া আর কোন ছায়াই নেই। (মুসলিম)


৩৭৮. হযরত আবু হুরাইরা (রা) বলেনঃ রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যার হাতে আমার প্রাণ সেই সত্তার কসম! তোমরা ঈমানদার না হওয়া পর্যন্ত জান্নাতে দাখিল হতে পারবে না। আর পরস্পর ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপন না করা পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না। আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি কাজের কথা বলে দেবো না, যা করলে তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসতে পারবে? (তাহলো) তোমরা পরস্পরের মধ্যে সালামের ব্যাপক প্রচলন করো।


৩৭৯. হযরত আবু হুরাইরা (রা) বলেনঃ রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ জনৈক ব্যক্তি তার এক (মুসলমান) ভাইয়ের সাথে সাক্ষাতের জন্য অন্য গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। পথিমধ্যে আল্লাহ তার জন্য অপেক্ষা করার উদ্দেশ্যে একজন ফেরেশতা নিযুক্ত করেন। অতপর তিনি এই কথা পর্যন্ত হাদীস বর্ণনা করেনঃ ‘(ফেরেশতা তাকে বলেন), নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে এরূপ ভালোবাসেন, যেরূপ তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাস। (মুসলিম)


৩৮০. হযরত বারাআ ইবনে আযেব বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসারদের সম্পর্কে বললেনঃ ঈমানদাররাই তাদের (আনসারদের) ভালোবাসেন আর মুনাফিকরাই তাদের ঈর্ষা করে। যে ব্যক্তি তাদের ভালোবাসে, আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন আর যে ব্যক্তি তাদের ঈর্ষা করে (বা শত্রুতা পোষণ করে) আল্লাহ তাকে ঈর্ষা করেন (অর্থ্যাৎ এর শাস্তি দেন)। (বুখারী ও মুসলিম)


৩৮১. হযরত মুয়ায (রা) বর্ণনা করেন আমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ মহাসম্মানিত পরাক্রমশালী আল্লাহ বলেনঃ আমার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে যারা পরস্পরকে ভালোবাসে, তাদের জন্য (আখিরাতে) থাকবে নূরের মিম্বার (মঞ্চ) আর নবীগণ ও শহীদগণ তাদের প্রতি ঈর্ষা করবেন। (তিরমিযী)


৩৮২. হযরত আবু ইদ্রিস আল-খাওলানী (রা) বর্ণনা করেন, একদা আমি দামেস্কের মসজিদে ঢুকে দেখি, চকচকে দাঁত বিশিষ্ট জনৈক যুবক এবং তার আশপাশে বহু লোকের সমাবেশ। লোকেরা যখনই কোন বিষয়ে মতভেদ করছে, তা তাঁর দিকে (সমাধানের জন্য) রুজু করছে এবং তাঁর সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাজ করছে। আমি তার পরিচয় জানতে চাইলে জবাবে বলা হলো, তিনি মুয়ায ইবনে জাবাল (রা)।   পরদিন সকালে আমি খুব তাড়াতাড়ি (মসজিদে) উপস্থিত হলাম এবং তাঁকে আমার পূর্বেই সেখানে উপস্থিত দেখতে পেলাম। তাঁকে নামায পড়তে দেখে আমি তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। তাঁর নামায শেষ হলে আমি তাঁর সামনে উপস্থিত হয়ে সালাম করে বললামঃ আল্লাহর কসম! আমি নিশ্চয়ই আপনাকে ভালোবাসি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন তা কি আল্লাহর জন্য? আমি বললাম, হ্যাঁ, আল্লাহর জন্য। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। এরপর তিনি আমার চাদরের এক অংশ ধরে তাঁর কাছে টেনে নিয়ে বললেনঃ সুসংবাদ গ্রহণ করুন; কেননা আমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, মহান আল্লাহ বলেছেনঃ যারা আমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পরকে ভালোবাসে, আমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পর বৈঠকে মিলিত হয়, আমার সন্তুষ্টি কামনায় পরস্পর সাক্ষাত করে এবং আমারই জন্য নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তাদেরকে ভালোবাসা আমার ওপর ওয়াজিব হয়ে যায়, অর্থ্যাৎ আমি তাদের ভালোবাসি। (মুআত্তা ইমাম মালিক)


৩৮৩. হযরত আবু কারীমাহ মিকদাদ ইবনে মা’দিকারিব (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কোন ব্যক্তি যখন তার এক মুসলমান ভাইকে ভালোবাসে, তখন তাকে অবহিত করা উচিত যে, সে তাকে ভালোবাসে। (আবু দাউদ ও তিরমিযী)


৩৮৪. হযরত মু’আয (রা) বর্ণনা করেন, একদা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার হাত ধরে বললেনঃ ‘হে মু’আয! আল্লাহর কসম! নিশ্চয়ই আমি তোমায় ভালোবাসি। এরপর তোমায় উপদেশ দিচ্ছি, হে মু’আয! প্রত্যেক নামাযের পর এই দো’আটি না পড়ে ক্ষান্ত হয়ো না, ‘আল্লাহুম্মা আইন্নী আ’লা যিকরিকা ওয়া শুকরিকা ওয়া হুসনি ইবাদাতিক’; অর্থ্যাৎ ‘হে আল্লাহ! তোমার স্মরণে, কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে ও উত্তমরূপে তোমার বন্দেগী করতে আমায় সাহায্য করো।’ (আবু দাউদ ও নাসাঈ)


৩৮৫. হযরত আনাস (রা) বর্ণনা করেন, একদা জনৈক ব্যক্তি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাশে উপস্থিত ছিল। এমন সময় অপর এক ব্যক্তি তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সে (উপস্থিত লোকটি) বললঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি লোকটাকে ভালোবাসি। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি কি এই বিষয়টি তাকে জানিয়েছো? সে বললোঃ না। তিনি বললেনঃ তাকে জানিয়ে দাও। সুতরাং সে তার সাথে দেখা করে বললোঃ নিশ্চয়ই আমি তোমায় আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় ভালোবাসি। সে বললোঃ আল্লাহ তোমায় ভালোবাসুন, যার জন্য তুমি আমায় ভালোবাস। (আবু দাউদ)


 

Was this article helpful?

Related Articles