অল্পে তুষ্টি, সহনশীলতা, মিতব্যয়ীতা, বিনা প্রয়োজনে কারো কাছে চাওয়ার নিন্দা সংক্রান্ত বর্ণনা

[Note: এ অধ্যায়ের কুরআনের আয়াত গুলো পরে আপডেট করা হবে]

 

৫২২. আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। নবী (সা) বলেনঃ অঢেল সম্পদ থাকলেই ঐশ্বর্যশালী হওয়া যায় না, বরং মনের ঐশ্বর্যই প্রকৃত ঐশ্বর্য। (বুখারী, মুসলিম)


৫২৩. আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ সেই ব্যক্তি কৃতকার্য হয়েছে, যে ইসলাম গ্রহণ করেছে, প্রয়োজন মাফিক রিযিকপ্রাপ্ত হয়েছে এবং আল্লাহ তাকে যা দান করেছেন তাতে সন্তুষ্ট থাকার তওফীকও দিয়েছেন। (মুসলিম)


৫২৪. হাকীম ইবনে হিযাম (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা) -এর কাছে কিছু চাইলাম। তিনি আমাকে দান করলেন। আমি পুনরায় তাঁর কাছে চাইলাম। তিনি এবারো আমাকে দান করলেন। আমি আবার চাইলে তিনি আমাকে দান করেন এবং বলেনঃ হে হাকীম! এ সম্পদ সবুজ শ্যামল ও মিষ্ট। যে ব্যক্তি নির্বিকার চিত্তে এ সম্পদ গ্রহণ করে, তার জন্য তাতে বরকত প্রদান করা হয়। আর যে ব্যক্তি লোভ-লালসার মন নিয়ে তা অর্জন করে, তার জন্য তাতে বরকত দেয়া হয় না। তার অবস্থা এরূপ হয় যে, কোন লোক খাবার খেলো; কিন্তু তাতে তৃপ্তি পেল না। উপরের হাত নিচের হাতের চেয়ে উত্তম (অর্থাৎ দানকারী গ্রহণকারীর চেয়ে উত্তম)।   হাকীম (রা) বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন, তাঁর শপথ এরপর থেকে দুনিয়া ত্যাগ না করা পর্যন্ত আমি কারো কাছে কিছু চাইবো না। অতঃপর আবু বকর (রা) হাকীমকে ডেকে কিছু (দান) গ্রহণ করতে বললেন। তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। অতঃপর উমার (রা) তাকে কিছু দেয়ার জন্য ডাকলেন, কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। তখন উমার বলেন, ‘ফাই’ আল্লাহ তাঁর জন্য যে প্রাপ্য নির্ধারণ করেছেন, সেই প্রাপ্য অংশ আমি তাঁর সামনে পেশ করেছি; কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে।৬৪ অতঃপর হাকীম (রা) নবী (সা) -এর পর থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত আর কারো কাছে কিছু চাননি। (বুখারী, মুসলিম)

*৬৪. “ফাই “বলা হয় যুদ্ধলব্ধ মালকে। তবে সাধারণত সামরিক পরিশ্রম ছাড়াই যে মাল পাওয়া যায় অর্থাৎ যুদ্ধে ঘোড়াও চালাতে হয়নি, অস্ত্রও ধারণ করতে হয়নি, অথচ শত্রুরা তাদের মাল ফেলে পালিয়ে গেছে বা সন্ধি করেছে। এরূপ অবস্থায় শত্রুপক্ষের যে মাল হস্তগত হয় তাকে ফাই বলে।


৫২৫. আবু মুসা আশ’আরী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা) -এর সাথে এক যুদ্ধে রওয়ানা হলাম। আমাদের প্রতি ছয়জনের মাত্র একটি উট করে উট ছিল। আমরা পালাক্রমে এতে আরোহণ করলাম। ফলে আমাদের পা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। আমার পা তো ক্ষতবিক্ষত হলোই, পায়ের নখগুলোও পড়ে গেলো। কাজেই আমরা পায়ে কাপড়ের পট্টি বেঁধে নিলাম। এজন্যই এ যুদ্ধের নাম হয়েছে ‘জাতুর-রিকা’ (পট্টির যুদ্ধ)।  কেননা আমাদের পা পদব্রজে ক্ষত-বিক্ষত হওয়ায় তাতে পট্টি বেঁধেছিলাম। আবু বুরদা বলেন, আবু মূসা (রা) এ হাদীস বর্ণনা করার পর তা অপছন্দ করলেন এবং বলেন, হায়! আমি যদি তা বর্ণনা না করতাম। আবু বুরদা বলেন, সম্ভবত তাঁর আমল প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার ভয়েই তিনি এটাকে খারাপ মনে করেছেন। (বুখারী, মুসলিম)


৫২৬. আমর ইবনে তাগলিব (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে কিছু মাল অথবা বন্দী হাযির করা হলো। তিনি সেগুলো বণ্টন করতে গিয়ে কতক লোককে দিলেন এবং কতক লোককে দিলেন না। তাঁর কানে এল যে, তিনি যাদেরকে দেননি তারা অসন্তুষ্ট হয়েছে। সুতরাং তিনি আল্লাহর হামদ ও সানা পাঠ করার বলেনঃ আল্লাহর শপথ! আমি কাউকে দিয়ে থাকি এবং কাউকে দেই না। আমি যাকে দেই না সে আমার কাছে সেই ব্যক্তির চাইতে বেশি প্রিয় যাকে আমি যদি দিয়ে থাকি। আমি তো এমন এক ধরণের লোকদের দিয়ে থাকি যাদের অন্তরে অস্থিরতা ও বিহ্বলতা দেখতে পাই। আর যাদের দিলে আল্লাহ প্রশস্ততা ও কল্যাণকামিতা দান করেছেন তাদেরকে তার উপর সোপর্দ করি। এই ধরণের লোকদের মধ্যে আমর ইবনে তাগলিব একজন। আমর ইবনে তাগলিব (রা) বলেন, আল্লাহর শপথ! আমার জন্য এ বাণী এতই মূল্যবান যে, এর বিনিময়ে লাল রংয়ের উট গ্রহণ করতেও আমি প্রস্তুত নই। (বুখারী)


৫২৭. হাকীম ইবনে হিযাম (রা) থেকে বর্ণিত। নবী (সা) বলেনঃ উপরের হাত নিচের হাত থেকে উত্তম? তোমার পোষ্যদের থেকেই দান শুরু কর। স্বচ্ছলতা বজায় রেখে যে দান খয়রাত করা হয় সেটাই উত্তম। যে ব্যক্তি পবিত্র ও সংযমী হতে চায় আল্লাহ তাকে সংযমী পবিত্র বানিয়ে দেন। যে ব্যক্তি স্বনির্ভর হতে চায় আল্লাহ তাকে স্বনির্ভর হতে দেন।

ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। হাদীসের মূল পাঠ বুখারীর এবং মুসলিমের পাঠ আরো সংক্ষিপ্ত।


৫২৮. আবু সুফিয়ান সাখর ইবনে হারব (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ তোমরা নাছোড়বান্দা হয়ে যাচ্ছেতাই করবে না। আল্লাহর শপথ! তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আমার কাছে কিছু চায় এবং তার চাওয়া আমাকে অসন্তুষ্ট করে কিছু আদায় করে নেয়, সে আমার প্রদত্ত মালে বরকত পাবে না। (মুসলিম)


৫২৯. আবু আবদুর রহমান আওফ ইবনে মালিক আল-আশজা’ঈ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা নয়জন অথবা আটজন অথবা সাতজন লোক রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি বলেনঃ তোমরা আল্লাহর রাসূলের কাছে আনুগত্যের বাইয়াত করছ না কেন? অথচ আমরা কিছু দিন পূর্বেই তাঁর হাতে বাইআত করেছি। সুতরাং আমরা বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমরা তো আপনার হাতে বাইআত করেছি। তিনি পুনরায় বলেনঃ তোমরা আল্লাহর রাসূলের কাছে বাইআত করছ না কেন? অতঃপর আমরা আমাদের হাত বাড়িয়ে দিলাম এবং বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা তো আপনার হাতে বাইআত করেছি, এখন আবার কিসের বাইআত করব? তিনি বলেনঃ এই বিষয়ের বাইআত যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করবে এবং তাঁর সাথে কোন কিছুর শরীক করবে না, পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়বে এবং আল্লাহর আনুগত্য করবে। আরেকটি কথা তিনি চুপিসারে বলেনঃ তোমরা মানুষের কাছে কিছুই চাইবে না। সুতরাং আমি নিজে এ দলের কয়েকজনকে দেখেছি যে, এমনকি তাদের কারো চাবুক মাটিতে পড়ে গেলেও তারা অন্য কাউকে তা উঠিয়ে দিতে বলতেন না। (মুসলিম)


৫৩০. ইবনে উমার (রা) থেকে বর্ণিত। নবী (সা) বলেছেনঃ তোমাদের যে ব্যক্তি সর্বদা চেয়ে-চিন্তে বেড়ায়, আল্লাহ তা’য়ালার সাথে সাক্ষাতকালে তার মুখমণ্ডলে এক টুকরা গোশতও থাকবে না। (বুখারী, মুসলিম)


৫৩১. ইবনে উমার (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) মিম্বারে উঠে দান সম্পর্কে এবং কারো কাছে কোন কিছু না চাওয়া সম্বন্ধে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেনঃ উপরের হাত নিচের হাতের চাইতে উত্তম। উপরের হাত হল দানকারীর হাত এবং নীচের হাত হল ভিক্ষুকের হাত। (বুখারী, মুসলিম)


৫৩২. আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লা‌হ (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি মাল বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে লোকদের কাছে ভিক্ষা করে, প্রকৃতপক্ষে সে জলন্ত অঙ্গার ভিক্ষা করে। অতএব সে তার ভিক্ষা মেগে বেড়ানো বাড়াতেও পারে বা কমাতেও পারে। (মুসলিম)


৫৩৩. সামুরা ইবনে জুনদুব (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ ভিক্ষা চাওয়াটাই হচ্ছে একটি ক্ষতবিশেষ। এর দ্বারা ভিক্ষাকারী তার মুখমণ্ডলকে ক্ষত-বিক্ষত করে। কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে কিছু চাওয়া বা যা না হলেই নয়, এরূপ ক্ষেত্রে চাওয়া যেতে পারে।

ইমাম তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করে বলেন, হাদীসটি হাসান ও সহীহ।


৫৩৪. ইবনে মাসঊদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ অভাব-অনটন যার উপর হানা দেয়, অতঃপর সে যদি তা জনসমক্ষে প্রকাশ করে তবে তার এ অভাব দূরীভূত হবে না। আর যে ব্যক্তি তার অভাব সম্পর্কে আল্লাহর শরণাপন্ন হয়; শিগগির হোক কি বিলম্ব হোক আল্লাহ তাকে রিযিক দেবেনই।

ইমাম আবু দাঊদ ও ইমাম তিরমিযী এ হাদীসটি বর্ণনা করেন এবং ইমাম তিরমিযী বলেন, হাদীসটি হাসান।


৫৩৫. সাওবান (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমার সাথে এই অঙ্গীকার করবে যে, সে কারো কাছে কোন কিছুই চাইবে না, আমি তার জন্য জান্নাতের যামিন হবো। আমি বললাম, আমি অঙ্গীকার করছি। (রাবী বলেন) এরপর থেকে তিনি (সাওবান) কারো কাছে কিছু চাননি। ইমাম আবু দাঊদ হাদীসটি সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন।


৫৩৬. আবু বিশর কাবীসা ইবনুল মুখারিক (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি (ঋণ বা দিয়াতের) যামিনদার হয়ে অপারগ হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে এ ব্যাপারে কিছু সাহায্য চাইতে আসলাম। তিনি বলেন, অপেক্ষা কর, এরি মধ্যে আমাদের মাঝে সদকার মাল এসে গেলে তোমাকে তা দেয়ার আদেশ দেবো। তিনি পুনরায় বলেনঃ হে কাবীসা! তিন ধরনের লোক ছাড়া আর কারো জন্য চাওয়া (ভিক্ষাকরা) বৈধ নয়ঃ (১) যে ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সে ঋণ পরিশোধ করা পর্যন্ত চাইতে পারে, অতঃপর তাকে বিরত থাকতে হবে। (২) যে ব্যক্তি এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়লো যা তার মালসম্পদ ধ্বংস করে দিল, সেও তার প্রয়োজন মেটাতে প্রয়োজন পরিমাণ চাইতে পারে অথবা তিনি বলেনঃ তার অভাব দূর হওয়া পর্যন্ত চাইতে পারে। (৩) যে ব্যক্তি দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছে এবং তার গোত্রের তিনজন সচেতন ব্যক্তি সত্যায়ন করেছে যে, অমুকের উপর দুর্ভিক্ষ হানা দিয়েছে, তার জন্যও প্রয়োজন মেটানো পরিমাণ সওয়াল করা বৈধ অথবা তিনি বলেনঃ অভাব দূও হওয়া পর্যন্ত চাওয়া বৈধ। হে কাবীসা! তিন প্রকারের লোক ছাড়া আর সবার জন্য কারো কাছে হাত পাতা হারাম এবং যে ব্যক্তি হাত পাতে সে হারাম খায়।

ইমাম মুসলিম হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন।


৫৩৭. আবু হুরাইরা হতে বর্ণিত রাসুলল্লাহ (সা) বলেনঃ সেই ব্যক্তি দরিদ্র নয় যে একটি গ্রাস ও দু’টি গ্রাস এবং একটি খেজুর বা দু’টি খেজুরের জন্য লোকের দ্বারে দ্বারে ঘোরে; বরং সে-ই প্রকৃত দরিদ্র, যার কাছে পরমুখাপেক্ষী না হয়ে থাকার মত সম্পদ নেই এবং তার দারিদ্র্য সম্পর্কে কারো জানাও নেই যে, তাকে কিছু দান করা যায়, আর সেও স্বেচ্ছায় কারো কাছে কিছু চায় না। (বুখারীম, মুসলিম)


 

Was this article helpful?

Related Articles